সাইবার স্পেসে ভুক্তভোগীদের দেওয়া মতামতের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সাইবার স্পেসে ভুক্তভোগীদের দেওয়া মতামতের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সংগঠনটির কার্যনির্বাহী সদস্য খালেদা আক্তার লাবনীর সঞ্চালনায় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা করেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া, বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান, সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতাবিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান প্রমুখ। ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে আলোচনায় অংশ নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিজিডি ই-গভ সার্ট প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম খান।
নতুন ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে : প্রতিবেদনে ১১টি ট্যাবে করা তথ্য বিশ্লেষণে ‘অন্যান্য’ অপরাধ ২০২২ সালের প্রতিবেদনে ছিল ১.৮১ শতাংশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অপরাধের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হলেও বিগত পাঁচ বছরে তুলনামূলকভাবে কমছে সাইবার বুলিং সংশ্লিষ্ট অপরাধের ঘটনা (অনলাইন ও ফোনে বার্তা পাঠানো, পর্নোগ্রাফি, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার ও ছবি বিকৃতি)। এ ধরনের অপরাধ ২০২২ সালে ৫২.২১ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল ৫৯.৯০ শতাংশ।
অনলাইন কেনাকাটা :
হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলোও ধারাবাহিকভাবে কমলেও আর্থিক সংশ্লিষ্ট প্রতারণা থেমে নেই।
শিশু ভুক্তভোগীর হার বেড়েছে :
২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪.৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০.৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি (২ শতাংশের বেশি) অপপ্রচারের শিকার হয় শিশুরা। বয়সভিত্তিক অপরাধের ধরনে ভুক্তভোগীদের মধ্যে তরুণরা (১৮-৩০ বছর) সর্বোচ্চ (১২ শতাংশের বেশি) একই ধরনের অপরাধের শিকার।
৭৫ শতাংশই তরুণ :
সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ৭৫ শতাংশের বয়সই ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ২০১৮ সালের জরিপ থেকে এ পর্যন্ত একাধারে এই বয়সী ভুক্তভোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে অপপ্রচার ও আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার।
দেশে বিভিন্ন সাইবার অপরাধ যেসব আইনে বিচার হচ্ছে সেগুলো হলো—বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। কিন্তু এসব আইন নিয়ে সচেতন নয় মানুষ।
আইন বিষয়ে জানেন না :
সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ৫৫ শতাংশই দেশের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন না। পাঁচ বছর ধরেই ভুক্তভোগীদের গড়ে প্রায় অর্ধেকই আইন বিষয়ে অজ্ঞ।
অভিযোগের হার কমেছে : জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ভুক্তভোগীদের মধ্যে অভিযোগকারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০১৮ সালের জরিপে যেখানে অভিযোগকারীর হার ছিল ৬১ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা কমে ২০.৮৩ শতাংশে নেমেছে।
সন্তুষ্ট নয় ৮০ শতাংশ ভুক্তভোগী :
২০২৩ সালের জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যেসব ভুক্তভোগী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ৮০ শতাংশই অভিযোগের পর ফল (আইনি ব্যবস্থা) নিয়ে অসন্তুষ্ট। তবে ২০২২ সালের জরিপে আগের বছরের তুলনায় বেশ উন্নতি লক্ষ করা গেছে। অবশ্য সেই বছরের জরিপে ৩৭.৬৯ শতাংশ ভুক্তভোগীই এই বিষয়ে মন্তব্য করেননি। বিপরীত এবারের জরিপে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয়ে মন্তব্য না করার হার ছিল ৪.৪৫ শতাংশ।
গবেষণার ফল নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সাইবার অপরাধ নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তুলে প্রযুক্তি ব্যবহারে নাগরিকের অভ্যাস ও আচরণগত উন্নয়নের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘নিজেদের তৈরি নয়, অজানা জায়গা থেকে আসা প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছেই। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের সলিউশনগুলো নিজেদেরই তৈরি করতে হবে।’
সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান বলেন, ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুলিশের সহায়তা না নেওয়ার হারটা বিপজ্জনক। এর পেছেনে ভুক্তভোগীদের প্রমাণ হাজিরের প্রক্রিয়াগত জটিলতাকে দুষছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সাইবার জগতে যাপিত জীবনের বিষয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে হবে। সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে শিশুদের ভুক্তভোগী হওয়ার সংখ্যা বাড়বে। আমাদের বুঝতে হবে ডিভাইসগুলো একদিকে যেমন বিনোদনের মাধ্যম, অন্যদিকে বিপজ্জনক। কেননা এটা আমাদের বিচ্ছিন্ন করছে, যার প্রমাণ একই রাতে বুয়েট ও রুয়েটের শিক্ষার্থীর আত্মাহত্যার দুর্ঘটনা। তাই রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনগুলো আরো দৃঢ় করতে হবে।
ব্রিগেডিয়ার জে. মো. নাসিম পারভেজ বলেন, ‘ইতিমধ্যেই আইএসপিদের প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার এবং মোবাইল অপারেটরদের সাইবার ডিভেন্স নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই সাইবার সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষায়িত কল সেন্টার স্থাপন করতে যাচ্ছি। তবে এরই মধ্যে কিশোরদের সাইবার সচেতনতায় ১৩২১৯ কল সেন্টার করা হয়েছে। এভাবেই মাল্টিস্টেক হোল্ডার অ্যাপ্রোচে সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। পাড়া-মহল্লার ক্লাবগুলোকে এই সচেতনতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, ‘সাইবার ঝুঁকি আগামীর জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ব্যান্ডউইডথ প্রবেশের সময়েই রাষ্ট্রের পক্ষেই এটি সুরক্ষিত কি না তা নিশ্চিত করা দরকার।’
আপনার মতামত লিখুন :