logo
Wednesday , 12 July 2023
  1. সকল নিউজ

ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় দেশের অর্থনীতি

প্রতিবেদক
admin
July 12, 2023 9:42 am

প্রবাসী আয়ের পর পণ্য রপ্তানিতেও বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে বছর শেষ করেছে। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য। এক অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

এদিকে ডলার সংকট নিয়ে বছরখানেক ধরেই দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। আর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল দুই উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দু’টি উৎস থেকেই গত বছরের শেষ দিকে বৈদেশিক মুদ্রা আসা কিছুটা কমে যায়। তবে পরে আবার তা ঘুরেও দাঁড়ায়। বিদায়ী অর্থবছর শেষে বৈধপথে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে ৩ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক, চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি বেড়েছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোমটেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমেছে। শুধু জুনে ৫০৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জুনের তুলনায় এই রপ্তানি ২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। প্রায় ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ আয় আসে এই খাত থেকে। বিদায়ী অর্থবছরেও দেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের অবস্থান বেশ ভালো ছিল। বিদায়ী অর্থবছরে দেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। ইপিবির তথ্যমতে, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৪ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। অর্থবছরটিতে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তৈরি পোশাক ছাড়া রপ্তানি আয়ের অন্যান্য খাত খুব একটা ভালো করতে পারেনি বিদায়ী বছরে। নেতিবাচক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষিপণ্যসহ হিমায়িত মাছ, রাসায়নিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, স্পেশাল টেক্সটাইল ও কার্পেটে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রপ্তানি কমেছে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ, হিমায়িত মাছে ২০ দশমিক ৭৬, রাসায়নিক পণ্যে ১৬ দশমিক ৭৭, রাবারে ২১ দশমিক ৯৪, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ১ দশমিক ৭৪, হ্যান্ডিক্রাফটসে ৩০ দশমিক ৫৪, সিল্কে ৩০ দশমিক ৬৯, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ১৯ দশমিক ১, কার্পেটে ৩২ দশমিক ২২ ও স্পেশাল টেক্সটাইলে রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আরও দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানি বেড়েছে কাঠ ও কাঠজাত পণ্য, প্রিন্টেড পণ্য এবং কটন ও কটনজাত পণ্যসহ অল্প কিছু পণ্যে।

গত অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি অর্থের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অর্থমূল্য বিবেচনায় গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শীর্ষ পাঁচ পণ্য ছিল যথাক্রমে পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিপণ্য। এর মধ্যে কেবল পোশাক রপ্তানিই বেড়েছে, যার হার ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১০৯ কোটি ৫২ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য। মোট রপ্তানিতে হোম টেক্সটাইল পণ্যের অংশ ছিল মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির অর্থমূল্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৯১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য। মোট রপ্তানিতে এ পণ্যের অংশ মাত্র ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১১৬ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের পণ্য। মোট রপ্তানিতে কৃষিপণ্যের অংশ কেবল ১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

ইপিবির মাসভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সদ্যসমাপ্ত জুনে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫১ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৫০৩ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য। আগের বছরের একই মাসে রপ্তানি হয় ৪৯০ কোটি ৮০ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য। গত মাসটি ছিল কোরবানি ঈদের মাস। এ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন দেশে। সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে ২২০ কোটি (২ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল তিন বছর পর একক মাসের হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সের পর বছর শেষে রপ্তানি আয়েও বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জুন মাসে ৫৩১ কোটি ডলার বা ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে দেশে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতির এই দু’টি খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। বিশেষ করে চলমান ডলার সংকট দূর করতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডক্টর আতিকুজ্জামন বলেন, ‘দেশের বর্তমান অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দু’টি সংকটের একটি হচ্ছে ডলারের বাজারে অস্থিরতা বা ডলার সংকট। আরেকটি হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এই সংকটময় অবস্থায় একই সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি অবশ্যই অর্থনীতির জন্য স্বস্তির খবর। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাই হবে চ্যালেঞ্জের। যদি এই হারে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে তা হলে দেশের অর্থনীতিও দ্রম্নত ঘুরে দাঁড়াবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি রেমিট্যান্সের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, জুন মাসে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত তিন বছরে সর্বোচ্চ। তিন বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২ দশমিক ৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল, যা একক মাসের হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে ওই অর্থবছরের মে মাসে, ২১৭ কোটি ১০ লাখ (২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন) ডলার। সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে এর চেয়েও বেশি অর্থ ২২০ কোটি (২ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তিন বছর পর এক মাসের হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে জুনে।

এদিকে জুনে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ কম অর্জিত হলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে আড়াই শতাংশ। গত বছরের এ সময়ে ৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ডলার সংকট, আমদানিতে বাধা ও কলকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির অভাবে বিগত কয়েক মাস ধরে রপ্তানি খাত প্রবৃদ্ধির মুখ দেখছিল না। মার্চে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, এপ্রিলে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে মে মাস থেকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে। সেই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৬ শতাংশের বেশি। জুন মাসে তা অব্যাহত থেকেছে। এ প্রবৃদ্ধির ফলে বিদায়ি অর্থবছরে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও বিদায়ি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। সেই লক্ষ্যের চেয়ে রপ্তানি কম হয়েছে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ বা ২৪৪ কোটি ডলার।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ডক্টর হাসানুজ্জামান সেলিম বলেন, ডলার সংকট নিয়ে বছরখানেক ধরেই দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। আর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল দুই উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দু’টি উৎস থেকেই গত বছরের শেষ দিকে বৈদেশিক মুদ্রা আসা কিছুটা কমে যায়। অবশ্য পরে তা ঘুরে দাঁড়ায়।

ইপিবির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিদায়ি অর্থবছরে তৈরি পোশাক, ও চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি বেড়েছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমেছে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। আর এই রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স। এই দুই খাতে আয় বাড়ায় রিজার্ভেও কিছুটা স্বস্তি ফিরবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ফেলো ডক্টর অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল রপ্তানি আয়। বছরজুড়েই রপ্তানি আয় ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় গিয়ে ঠেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি। রপ্তানির পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকেও স্বস্তি ছিল। যদিও গত কয়েক মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধ পথে প্রবাসীদের পাঠানো আয় কমছিল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই আয়। বছরের হিসাবে দেশে রেকর্ড ২২ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে দেশে। অন্যদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার পর দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার বন্যা বইতে শুরু করেছে। প্রতি মাসেই রেকর্ড হচ্ছে। এছাড়া বিদেশি ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রে ভাল একটা বছর পার করল বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি চোখ রাঙালেও এখনো সহনীয় পর্যায়েই আছে। এটাকে সামাল দেওয়া গেলে আর পেছনে তাকাতে হবে না, দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

সর্বশেষ - সকল নিউজ