বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেওয়া উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আজ গৌরবোজ্জ্বল ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি আওয়ামী লীগ। জন্মের পর থেকে বেশির ভাগ সময়ই গেছে লড়াই-সংগ্রামে। সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির অর্জন অনেক।
তবে টানা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দৃশ্যত এখনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সামনে আসছে নির্বাচন, বিরোধীরা একদিকে রাজপথ উত্তপ্ত করার পথে এগোচ্ছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সরকারকে ফেলেছে চাপে। নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় দল গোছাচ্ছে দলটি। টানা তৃতীয় বারসহ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা টানা সাড়ে ১৪ বছর ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে বারবার হোঁচট খেয়ে দলটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন যতটা শক্তিশালী, তা যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ঈর্ষণীয়। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গত ৬ দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য স্বত্ব হিসেবে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ। এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রত্যুজ্জ্বল।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে ষড়যন্ত্রের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে । ’৪৭-এর দেশ বিভাগ, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর যুগান্তকারী নির্বাচন
আর ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন—সবখানেই সরব উপস্থিতি ছিল আওয়ামী লীগের। আর এসবের অধিকাংশ আন্দোলনের কৃতিত্ব এককভাবে আওয়ামী লীগের।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রথম কাউন্সিলে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হককে যথাক্রমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বন্দি অবস্থায় তাকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রথম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। পরে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন। ’৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে দলের আন্তর্জাতিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে প্রথম বারের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। আর মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ আর সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়। ১৯৬৪ সালে দলটির কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন।
১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এর পরে ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় পঁচাত্তরে কারাগারে ঘাতকদের হাতে নিহত জাতীয় নেতাদের এক জন এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন মো. জিল্লুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের ওপর মরণাঘাত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবারও স্থগিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে মহিউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। ১৯৭৭ সালে এই কমিটি ভেঙে করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এতে দলের আহ্বায়ক করা হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক উকিলকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুর রাজ্জাক। এর পরই শুরু হয় আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব, উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়া। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশে ফেরার আগেই ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আব্দুর রাজ্জাক। আবারও আঘাত আসে দলটির ওপর। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা ও মো. জিল্লুর রহমান যথাক্রমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও আব্দুল জলিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তৎকালীন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আর এই কাউন্সিলের মাধ্যমে তারুণ্যনির্ভর কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি। সরকারে আসার পর দলটির সফলতা অনেক। গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতি বহুগুণে শক্তিশালী হয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বেড়েছে বাংলাদেশের গুরুত্ব ও সুনাম। সরকার ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে মহাশূন্যেও নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য হয়ে দেশের যোগাযোগ খাতে রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, দুর্নীতি ও যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারের অপশক্তি জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন।
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—আজ শুক্রবার সূর্যোদয়ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৭টায় ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন। সকাল সাড়ে ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দলের পক্ষ থেকে এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতির বক্তব্য রাখবেন।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী :এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ভূখণ্ডে প্রতিটি প্রাপ্তি ও অর্জন সবই জাতির পিতা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাঙালির অর্জন এবং বাংলাদেশের সব উন্নয়নের মূলেই রয়েছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মাটি ও মানুষের দল। জনগণই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি।
আপনার মতামত লিখুন :