দুই বছর অপেক্ষার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশের মাটি থেকেই মেইড ইন বাংলাদেশ রকেট উৎক্ষেপনের অনুমতি পেয়েছে ‘ধূমকেতু এক্স’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মাসে পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপন হবে বাংলাদেশের প্রথম রকেট “ধূমকেতু এক্স একুশ”। এই সিরিজে আছে রয়েছে ধূমকেতু ১, ২, ৩, ৪ এবং একুশে-১ রকেট। সূত্রমতে, বান্দরবন কিংবা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে এই উৎক্ষেপন কাজ সম্পন্ন হবে সরকারি গাইড লাইন অনুযায়ী।
উদ্ভাবকদের প্রাপ্ত অনুমতি অনুযায়ী, গবেষণা কাজের জন্য মহাকাশের দেড় কিলোমিটার দূরত্বে পাঠানো হবে একুশে সিরিজের রকেট। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের সার্কিট ও সেন্সরসমৃদ্ধ এই রকেটগুলো উৎক্ষেপনের মাধ্যমে পৃথিবীর উচ্চ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, আদ্রতা ও বাতাসের নিয়ে আবহাওয়ার বিভিন্ন বার্তা সংগ্রহ করে আবার ফিরিয়ে আনা হবে।
আইসিটি বিভাগের অধীন এটুআই প্রকল্প আয়োজিত প্রথম রকেট্রি চ্যালেঞ্জে ১২৪টি টিমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে ধূমকেতু দল লাভ করে ৫০ লাখ টাকার অনুদান। সেই অর্থ দিয়ে ৪টি রকেট বানিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশে প্রথম মহাকাশ গবেষণা উন্নয়ন কোম্পানি ধূমকেতু এক্স। ধূমকেতু-১ মডেলের দুইটি এবং ধূমকেতু-২ নামে আরো দুটি। ধূমকেতু-১ লম্বায় ৮ ডায়ামিটার, আয়তনে ৬ ডায়ামিটার। আর ৬ ডায়ামিটার দৈর্ঘ্যের ধূমকেতু-২ এর আয়তন ৪ ডায়ামিটার। আর ৫২ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে সক্ষম রকেটটির ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ‘ধূমকেতু এক্স’এর প্রধান নির্বাহী নাহিয়ান আল রহমান অলি। তবে এখনো বাজেট ছাড় না পাওয়ায় কাজটি আপতত স্থগিত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
অলি আরো জানালেন, এটুআই এর ইনোভেশন তহবিল থেকে প্রাপ্ত ৫০ লাখ টাকা বাজেটের রকেট একুশে-১ থেকে ৪ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের সার্কিট ও সেন্সরসমৃদ্ধ। এগুলো ফেব্রুয়ারিতে প্রথম উৎক্ষেপিত হবে, যা পৃথিবীর উচ্চ বায়ুমণ্ডলে নিয়ে আবহাওয়ার বিভিন্ন বার্তা সংগ্রহ করে আবার ফিরিয়ে আনা হবে। তবে এর দূরত্ব সময় বিমান বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সনদের ভিত্তিতে সরকার ঘোষণা দেবে। তবে গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারিতে ‘পুঁটি মাছ’ এর ইঞ্জিন পরীক্ষায় এর রেঞ্জ এক কিলোমিটার পর্যন্ত সফল হয়েছে। আর একুশে-৫২ এর রেঞ্জ হবে ৫২ কিলোমিটার। সব ঠিক থাকলে এ বছরের মাঝামাঝি উৎক্ষেপন করা সম্ভব হবে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে প্রদর্শন করা হয়েছিলো ৪৫ কেজি ওজনের রকেট “ধুমকেতু এক্স একুশ”। পরিদর্শন শেষে এই উদ্যোগকে চাঁদ ও মঙ্গল জয়ে দামালদের জন্য অনুপ্রেরণা বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম এর প্রেসিডেন্ট এবং নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ এর এডভাইজার আরিফুল হাসান অপু। তার ভাষায়, ‘একটি রকেট লঞ্চিং জাতিকে বিজ্ঞান মুখী করতে খুবই গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রী এবং বাচ্চা যারা স্বপ্ন দেখছে যে কোন এক সময় আমরাও চাদে যাবো, মঙ্গলগ্রহে যাবো এবং সেখানে স্পেস এক্সপ্লোরেশন করবো আমি মনে করি তাদের জন্য এটি একটি বিশাল অনুপ্রেরণা।’
এই অনুপ্রেরণাদায়ী স্বপ্নবাজ তরুণের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেলো, ছোটবেলা থেকে বিমান ও রকেট আবিষ্কারের নেশা ছিলো নাহিয়ান আল রহমানের। সেই স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করে ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির পর। গাইবান্ধায় বেড়ে ওঠা এই যুবক সাহস করে স্পেস এক্স হওয়ার স্বপ্নে গড়ে তোলেন ‘ধূমকেতু এক্স’ স্টার্টআপ। এ কাজে বন্ধুরাও সহায়তা করেছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত পত্রিকা ধূমকেতুর সাথে মিলিয়ে রকেটগুলোর নাম রাখা হয়েছে ধূমকেতু। সেসময় ৩০ জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পাঁচ বছরের চেষ্টায় তৈরি করেন ‘ধূমকেতু এক্স’নামের এটি রকেট। নিজের প্রাইভেট পড়ানোর জমানো টাকা আর মায়ের ব্যাংক হিসাব থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ এই পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করেন নাহিয়ান। বিনিয়োগের এই অঙ্কটা এক সময় ১২ গুণ ছাড়িয়ে যায়। এরপর সলিড জ্বালানির দুটি ইঞ্জিন তৈরি করে গড়ে তোলেন ১০ ফুট উচ্চতার প্রোটোটাইপ রকেট। এখন দেশেই টেকসই একটি রকেট ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেও ধূমকেতু এক্স-এ যুক্ত রয়েছেন বাংলাদেশী ১২৪ জন রকেট গবেষক। বাংলাদেশকে স্যাটেলাইট উৎপাদক দেশের কাতারে নিয়ে যেতে গবেষণা করছেন তারা। এর মাধ্যমে ১৯৫৭ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারত যে কাজটা শুরু করেছিলো ২০২২ এ এসে সেই কাজ শুরু করলো ধূমকেতু এক্স। এতো পরে এসে শুরু করে সাফল্য মিলবে কি? এমন সংশয়ের জাবাবে অলি বললেন, ‘এখন টেকনোলজি খুব ফাস্ট। আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার যে গবেষকরা এখন আমেরিকা-রাশিয়া-ভারত-চায়নায় রয়েছেন তাদের নিয়ে এজন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। তাই আমাদের ক্যাচআপ করতে বেশি সময় লাগবে না। সরকারী নীতি ও আর্থিক সহযোগিতা ফেলে ২০২৬-২৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ থেকেই ন্যানো স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের একটি ভেহিক্যাল টেস্টকররো করবো। সেটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে হবে। নজরুল-১ রকেট ২৬০ কেজি পেলোড নিয়ে লো-অরবিটে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এভাবেই একদিন আমরা নিজেরাই বঙ্গবন্ধু-৫ বা ৬ উৎক্ষেপন করতে পারবো।’
সেই প্রচেষ্টায় যুক্ত আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারো স্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবেডেড সিস্টেম প্রকৌশল প্রধান ইরফান মাহমুদ তুষার, ইউরোপিয় কমিশনের ইরামাস মান্ডাস স্কলারশিপ প্রাপ্ত প্রকৌশলী সাইদুর রহমান, অ্যারো স্পেস স্পেশালিস্ট শাহরুখ খান, ময়মনসিংহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার প্রকৌশলী আদিল আরহাম, ফজলে রাব্বি বিন্দু, আশরাফ মিয়া জান্নাতুল নাইম, পদ্মা স্মার্ট টেকনোলজি’র তাজমিউল হাসান, পরিবেশ বিশ্লেষক নাদিম আহমেদ, কেমিক্যাল গ্রাফিক প্রকৌশলী লিয়ান মল্লিক লিহান, এআই এনিমেটর রোহান বিন মিজান, যন্ত্রপ্রকৌশলী সারা করিম, তড়িৎ ও ম্যাটেরিয়াল প্রকৌশলী বৃষ্টি পল প্রমুখ।
এভাবেই এই তরুণ প্রকৌশলী ও উদ্ভাবকদের হাত ধরেই একদিন মহাকাশেও নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে বাংলাদেশ। বিশ্বে ১৫তম নিজস্ব মহাকাশ উৎক্ষেপন কারীর ক্লাবের সদস্য হতে পারবে। এই বড় ধাপ উত্তীর্ণ হতে পারলে বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আমেরিকা ও রাশিয়ায় ব্যয় হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে। উন্মুক্ত হবে স্যাটেলাইট রাফতানির দ্বারও। তবে তা ২০৩০ সালের আগে সম্ভবনা একে বারেই ক্ষণ। অবশ্য ২০৪১ সালের স্মার্ট সোনারবাংলার স্বপ্ন পূরণে আমরা বুক বাধতেই পারি।