logo
Wednesday , 26 July 2023
  1. সকল নিউজ

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট সমবায়ীদের টাকা লুটে বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট

প্রতিবেদক
admin
July 26, 2023 9:21 am

সমবায় অধিদপ্তরের দুর্নীতির অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ঘরের খবর চলে যাচ্ছে পরের হাতে। তাদের সম্পদের চাঞ্চল্যকর তথ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি অধিদপ্তরে দুদকের অভিযানের পর দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের অপকর্মের নথিপত্র জমা পড়ছে সংস্থাটিতে। তাতেই ফাঁস হচ্ছে কর্মকর্তাদের বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাটের চিত্র। অভিযোগ আছে, ভাগ্য বদলের স্বপ্নে বিভোর সাধারণ সমবায়ীদের টাকা লুটে নিজেরাই সম্পদ গড়ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বিভাগীয় তদন্তে একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সদিচ্ছা দেখালে অধিদপ্তরের দুর্নীতি বন্ধে একমাত্র দুদকই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে। দুদক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য ও যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটে জড়িত যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির তাদের মধ্যে অন্যতম যুগ্ম-নিবন্ধক মিজানুর রহমান। দীর্ঘদিন খুলনা বিভাগে কর্মরত তিনি। তার দুর্নীতিতে ডুবছে খুলনা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়। তার বিরুদ্ধে বটিয়াঘাটা গরু মাংস বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের ৫৯ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ আছে। সম্প্রতি তিনি মোটা টাকা ঘুস নিয়ে সমবায় আইন লঙ্ঘন করে যশোর মমিননগর কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির কমিটি ভেঙে দিয়ে অ্যাডহক কমিটি দিয়েছেন। এভাবে সমবায়ীদের ‘পায়ে কুড়াল’ মেরে তিনি নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। খুলনা শহরের নিরালা মোড়ে ২৬ নম্বর রোডের ৪৫৫ নম্বর হোল্ডিংয়ে অংশীদারিভিত্তিতে তৈরি করেছেন বিশাল অট্টালিকা। নজরকাড়া সাত তলা এই বাড়ির দোতলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি। এছাড়াও খুলনা শহরে তার আরেকটি বাড়ি নির্মাণাধীন আছে। রয়েছে সাত একর জায়গায় মাছের ঘের। ঢাকার মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতালের বিপরীতে কাজীপাড়ায় রয়েছে আলিশান অ্যাপার্টমেন্ট। ঢাকায় এলে এখানেই থাকেন তিনি। তার এসব সম্পদের মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। সরকারি দুটি গাড়ি তিনি সার্বক্ষণিক ব্যবহার করেন। একটিতে নিজে অপরটিতে চড়েন তার স্ত্রী। ১২ জন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তিনি যুগ্ম-নিবন্ধক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। একজন প্রতিমন্ত্রীর ছেলের তদবিরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি পদোন্নতি বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ আছে।

উল্লিখিত অভিযোগ সম্পর্কে মোবাইল ফোনে কল করে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড না। আপনারা আপনাদের কাজ করেন। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। তবে আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে জানতে চাইলে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে হবে।’ দুর্নীতিবাজ হিসাবে আলোচিত আরেক কর্মকর্তা হলেন যুগ্ম-নিবন্ধক মশিউর রহমান। ‘দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণ প্রকল্প’র পরিচালক তিনি। এই প্রকল্প সাধারণ সমবায়ীদের ভাগ্য বদলাতে না পারলেও নিজের ভাগ্য বদলে নিয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে প্রকল্পের টাকা লোপাটের বাইরেও অধিদপ্তরে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও বিভাগীয় মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। এ কাজে তাকে মদদ দেন একজন প্রতিমন্ত্রীর ছেলে। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগও আছে। ২০১৯ সালে রাজধানীর মিরপুরে অভিজাত বিজয় রাকিন সিটিতে ১৫৫৩ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। তখন ফ্ল্যাটটির বাজার মূল্য ছিল অন্তত দেড় কোটি টাকা। বগুড়ায় ২০১০ সালে তখনকার বাজার মূল্য ৬০ লাখ টাকায় আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে তদবিরবাজ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত জনৈক সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের প্রভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে।

অভিযোগ সম্পর্কে মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি যেসব সম্পদ করেছি তা বৈধ আয় দিয়েই করেছি। দুদক চাইলে সেগুলো দেখানো হবে। আমি কোনো অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত নই। আসলে ডিপার্টমেন্টে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে। ষষ্ঠ গ্রেডে উপনিবন্ধক হিসাবে পদোন্নতি পেয়ে নবম গ্রেডের সহকারী নিবন্ধকের জেলা সমবায় অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেছি এটা ঠিক। তবে এটা ডিপার্টমেন্টের আদেশেই করেছি।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, যুগ্ম-নিবন্ধক আশীষ কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। তদবিরের মাধ্যমে চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আছেন। তিনি অধিদপ্তরের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যে জড়িত সবচেয়ে আলোচিত কর্মকর্তা বাবলা দাশ গুপ্তের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে পরিচিত। বাবলা দাশ গুপ্তের দ্বিতীয় স্ত্রী জয়শ্রী দাশের মাধ্যমে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে তিনি বিত্তবান হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ২০২১ সালে তিনি চট্টগ্রামের ৭৯ চান্দমারি রোডে বিটিআই কোম্পানির তৈরি বিলাসবহুল ভবনে ফ্ল্যাট কিনেছেন। পটিয়া উপজেলার মনষা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে সাফ কবলা দলিলে তিনি ফ্ল্যাটটি কিনে নেন।

জানতে চাইলে যুগ্ম-নিবন্ধক আশীষ কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া মিডিয়ায় কথা বলা নিষেধ আছে। বদলি বাণিজ্য ও ফ্ল্যাট কেনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।’

জানা গেছে, অধিদপ্তরে দুর্নীতিবাজ হিসাবে আলোচিত আরেক কর্মকর্তা হলেন যুগ্ম-নিবন্ধক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস। যুগ্ম-নিবন্ধক প্রশাসন থাকাকালে তিনি সরকারি সম্পদের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হয়েছেন। তার দুর্নীতির বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুমোদন ছাড়াই তিনি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা সফর করেন। একবার সফরকালে তার গাড়ি সিরাজগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়ে। এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। দুর্ঘটনার দুই বছর পর তিনি ব্যক্তিগত ১৭ লাখ টাকা খরচ করে গাড়িটি মেরামত করে দেন। এরপর অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক তরুণ কান্তি শিকদার বিধিবহির্ভূতভাবে ওই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। তার বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও চাঁদাবাজির অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন। তার অবৈধ আয়ের প্রায় পুরোটাই ভারতে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। সেখানে তিনি বাড়িসহ অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অধিদপ্তরে গুঞ্জন আছে।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মৃণাল কান্তি বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মৌখিক অনুমতি নিয়ে গাড়ি ব্যবহারের সময় দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। ব্যক্তিগত টাকায় আমি গাড়ি মেরামত করে দিয়েছি। এরপরও বিভাগীয়ভাবে আমাকে তিরস্কার দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করেছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তাদের ব্যাপারে আমি সচিব মহোদয়কে লিখেছি। তিনি চাইলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।’

আরও জানা গেছে, সমবায় খাতের দুর্নীতি খুঁজতে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করছে। এরই মধ্যে মৃণাল কান্তি বিশ্বাস ও বাবলা দাশ গুপ্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তবে ওই সুপ্রিয় ভট্টচার্যের তদবিরে যুগ্ম-নিবন্ধক মিজানুর রহমান, মশিউর রহমান ও আশীষ কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে এখনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদকে অভিযোগ হলেও তাদের অবৈধ সম্পদ খুঁজতে অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়নি।

একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বিস্ময়কর তথ্য। তা হচ্ছে, মিজানুর রহমান, মৃণাল কান্তি বিশ্বাস ও মশিউর রহমান সহকারী নিবন্ধক হিসাবে নবম গ্রেডে জেলা সমবায় অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। উপনিবন্ধক হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার (৬ষ্ঠ গ্রেড) পরও তারা সবাইকে ম্যানেজ করে নবম গ্রেডের জেলা সমবায় অফিসারের পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ নিচের পদ হলেও সেখানে অবৈধভাবে ‘উপরি’ আয়ের বেশি সুযোগ রয়েছে।

দুদকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সামগ্রিকভাবে যেহেতু সমবায় খাতের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে, সেহেতু ওই দলই এদের দুর্নীতির খোঁজ নিতে পারে। এনফোর্সমেন্ট বিভাগের দলটি এদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করা যাবে।

সর্বশেষ - সকল নিউজ