আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তির বহুবিধ উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন এসেছে বাংলাদেশেও। ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার খাতে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণে কতটুকু সাফল্য হয়েছে, সেটাদেখা যাক-
সরকার ইতোমধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং তাই প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় সদরে একটি করে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকবে। এখানে থাকবে হাজার হাজার আইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সফটওয়্যার হাউস এবং ডাটা এন্ট্রি সেন্টার। কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ওসফটওয়্যার আমদানি শুল্কমুক্ত। VSAT ব্যবহার উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং উচ্চ গতির ডিজিটাল ডেটা নেটওয়ার্ক ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে ই-গভর্নেন্স, ই-কমার্স, অনলাইন নেটওয়ার্কিং, ওয়েব সার্ফিং, ওয়েব ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, আইএসপি এবং মেডিক্যাল ডেটা ট্রান্সক্রিপশন পরিষেবা, ডেটা এন্ট্রি, ইত্যাদি আজকাল অবিশ্বাস্য উন্নতির সম্মুখীন হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলো ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালু করেছে। ডিজিটাল অর্থনীতির মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে ১,৭৯৬.৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন জেলায় ১২টি হাই-টেক ও আইটি পার্ক স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত জেলাসমূহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, গোপালগঞ্জ, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, নাটোর জেলাগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও কক্সবাজার। বিদ্যুৎ, পানি, ইত্যাদির মতো চাহিদা পূর্ণ স্থান দখল করেছে ইন্টারনেট। সরকারি-বেসরকারি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে না।
৯০ দশকের ৬৪ কিলোবিট/সেকেন্ড এর গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট এখন ৪ গিগাবিট/সেকেন্ড গতিতে চলছে এবং ৫জি অতি আসন্ন। দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ও প্রতিযোগিতামূলক সেবা প্রদানের জন্য অনেক সংখ্যক সার্ভিস প্রোভাইডার কাজ করছে। যেকোনো পরিষেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি মজবুত ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো। দেশে মে, ২০২৩ পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৬১ লাখ। সহজেই অনুমেয় হয় যে এই সেবার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, উক্ত অবকাঠামোর সুষ্ঠু ব্যবহার করে ‘ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সার্বিকমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
অভাবনীয় সাফল্য এসেছে টেলিযোগাযোগ খাতেও। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অব বাংলাদেশ- এর তথ্য সূত্রানুযায়ী অক্টোবর, ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ১৮৯.৬৭ মিলিয়ন। যার ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি, অর্থাৎ মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৭.৭৮ শতাংশ। এছাড়াও রয়েছে পিএসটিএন ও আইপি ফোনের মতো পরিষেবা। কথোপকথোন ছাড়াও ক্ষুদেবার্তা থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রম পর্যন্ত চালু হয়েছে এই টেলিযোগাযোগের উপর ভর করে। বাংলাদেশের একটি নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে নাম বঙ্গবন্ধু-১। এটি ১২ মে, ২০১৮ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। যদিও সর্ব প্রথম ও রাষ্ট্রিয় স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপিত হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরপরই জুন, ১৯৭৫-এ।
আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকায় স্যাটেলাইটনির্ভর ট্রান্সমিশনের জন্য বিদেশী কোনো স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিতে হচ্ছে না। আভ্যন্তরীণ ব্যান্ডউইডথ এর চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দেওয়া সম্ভব। অবাধ তথ্য বিনোদনের চাহিদা পুরনেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচার মাধ্যমের পাশাপাশি রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচার মাধ্যম। বর্তমানে দেশে টেলিভিশন ৩৫টি (আরও ১০টি সম্প্রচারের অপেক্ষায়), রেডিও ২৮টি, কমিউনিটি রেডিও ৩২টি এবং ১০০টিরও অধিক অনলাইন পোর্টাল।
দেশী-বিদেশী তথ্য ও সংবাদ ছাড়াও সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, শিক্ষা, ক্রীড়া, কৃষিসহ নানা রকম বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছে এই মাধ্যমগুলো। রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফুটপ্রিন্ট কাভার করলেও অনলাইনের ক্ষেত্রে তা আনবাউন্ড অর্থাৎ বিশ্বের সর্বত্র এর এক্সেস সম্ভব। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, প্রযুক্তির এই সুবিধাসমূহ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। উল্লেখ করার মতো প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে এ খাতে যেমন-নিজস্ব বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সবচেয়ে বেশি ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারকারী হলো- দেশের সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানসমূহ। টেলিভিশনগুলো স্ট্যান্ডার্ড-ডেফিনেশন থেকে হাই-ডেফিনেশন এ ট্রান্সফার হচ্ছে। আঊটডোর লাইভ সম্প্রচারের ক্ষেত্রে এসেছে অনেক আধুনিকতা। এনালগ যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ক্যাবল টিভি শতভাগ ডিজিটালাইজেশনের পথে। অনুমতি পাচ্ছে আইপি টিভি। সম্প্রতি সম্প্রচার কারিগরি মান উন্নয়ন ও দক্ষকর্মী তৈরির লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘বাংলাদেশ ব্রডকাস্টারস অ্যাসোসিয়েশন (BBA)’। আশা করা যায় বিদ্যমান অবকাঠামোগত
সুবিধাসমুহকে ব্যবহার করে এই সংগঠনটি আরও উন্নয়নমূলক কাজের অংশীদারি হবে। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে যে সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত, এ সকল যন্ত্রপাতির উৎপাদন বা বিক্রয়-বিপণন প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কোনো অফিস বা সার্ভিস সেন্টার না থাকায় ত্রুটিযুক্ত যন্ত্রপাতি রিপ্লেস বা সারানোর কোনো ব্যবস্থা থাকে না, ফলে এটিও একটি আর্থিক ক্ষতির বিষয়। বর্তমানে দেশে অডিও, ভিডিও ও পিকচারাইজেশন নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে কিন্তু ব্যবহার উপযোগী কারিগরি মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখনো তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। হয়ত অচিরেই এ সকল সমস্যার সমাধান হবে। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা, বাণিজ্য ও বাণিজ্য, নতুন দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নেট পেমেন্ট, অভিযোগের প্রতিকার এবং যা আমরা কল্পনা করতে পারি তাতে পরিষেবার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে এই প্রযুক্তি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সরকারি পর্যায়ে কিছু কিছু বিষয়ে লক্ষ্য প্রদান করা এখন সময়োপযোগী হয়েছে। যেমন- এক সেক্টরের বাণিজ্যনীতি যেন আরেক সেক্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। সুবিশাল এই প্রযুক্তি সেক্টরগুলোতে বেসরকারি প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীসহ বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন কাজ করছেন।
তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রযুক্তির এতো উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত- উপদেষ্টা থেকে একেবারে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত সকল মানুষ এদেশেরই। ভাবতেই ভালোলাগে, যে দেশকে বিশ্বের বুকে একটা সময় খুবই ছোট করে দেখা হতো, স্বল্প শিক্ষিত দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত হতো, সে দেশের মানুষ এখন প্রযুক্তি নিয়ে খেলা করে।