logo
Tuesday , 7 November 2023
  1. সকল নিউজ

বঙ্গবন্ধু টানেলকে কেন্দ্র করে বিদেশী বিনিয়োগ

প্রতিবেদক
admin
November 7, 2023 9:19 pm

বাংলাদেশের ইতিহাসে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরেক মাইলফলক অর্জন হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। গত ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে টানেলের উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় এক ডজনের বেশি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এই টানেল আরেকটি নতুন সংযোজন।

কিছুদিন আগে ঢাকায় হযরত শাহ জালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন হয়েছে। তারও আগে পদ্মা সেতুর রেললাইনের উদ্বোধন হয়েছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উদ্বোধন হয়েছে ঢাকার মেট্রোরেলের দ্বিতীয় অংশ- আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত লাইন। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে একের পর এক দীর্ঘমেয়াদি এবং যুগান্তকারী সব অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন সমাপ্ত হয়েছে এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেড় যুগ হবে উন্নতির সোপান নির্মাণের এক স্মরণীয় সময়। কারণ, এই সময়ে দেশে সর্বাধিক সংখ্যক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে তার সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সেসব অবকাঠামো এখন দৃশ্যমান এবং জনগণ সুবিধা পেতে শুরু করেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের দৃষ্টান্ত সমসাময়িক বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশেও আগামীতে এতটা অবকাঠামো মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটানা দেশ চালানোর সুযোগ পেয়েছেন। এবং সেই সুযোগে যথেষ্ট দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। এক কথায় বলা যায়, অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ এক ধরনের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, যার কৃতিত্ব দেশের জনগণের হলেও একক নেতৃত্বের কৃতিত্ব অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

আজ অনেকেই অনেক কথা বলেন। অনেক পেশাজীবীও বেশ সমালোচনার চেষ্টা করেন। তারা কি আজ থেকে দেড় যুগ আগে কখনো কল্পনা করেছিলেন যে, বাংলাদেশে নদীর তলদেশ দিয়ে একটি টানেল নির্মিত হবে এবং সেই টানেল দিয়ে দ্রুতগতির গাড়ি চলবে। বা পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু হবে এবং সেই সেতু দিয়ে মাত্র চার ঘণ্টায় দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাবেন! ঢাকার মেট্রোরেল দিয়ে মাত্র ৪৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল চলে যাবেন। নিশ্চয়ই আমরা কেউ এমনটি স্বপ্নেও ভাবিনি। অথচ এগুলো সবই আজ বাস্তবতা এবং আমাদের সবার কাছে দৃশ্যমান। এত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। নির্মাণাধীন অন্যান্য অবকাঠামো, বিশেষ করে সকল রেললাইন এবং মহাসড়কের কাজ সম্পন্ন হলে সমগ্র বাংলাদেশ তখন মাত্র ছয় ঘণ্টার দূরত্বের মধ্যে চলে আসবে। যোগাযোগের এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থনীতির চাকাও সচল হবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
দেশের অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোর তুলনায় বঙ্গবন্ধু টানেলের পৃথক কিছু বিশেষত্ব আছে। এই টানেল বাংলাদেশেই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম নদীর তলদেশের সড়কপথ। এই টানেল নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। ফলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অনেক নদীর ওপর পরিবেশের ক্ষতি করে সেতু নির্মাণের পরিবর্তে তলদেশ দিয়ে এ রকম আরও অনেক টানেল নির্মাণ করা সহজ হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে অনেক সেতুই নির্মাণের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে টানেল হতে পারে পরিবেশবান্ধব ভালো বিকল্প। বঙ্গবন্ধু টানেলের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি নির্মিত হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে, যেখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দর দিয়েই দেশের অধিকাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। ফলে, এই টানেলকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিদেশী বিনিয়োগের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইতোমধ্যে টানেলকে কেন্দ্র করে দুই প্রান্তের শহরকে চীনের সাংহাই শহরের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। আসলেই সাংহাই শহরের মতো দুই প্রান্তে এত ব্যাপক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে কিনা, তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। তবে এই টানেলকে কেন্দ্র করে যে ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ, এই অঞ্চলের কিছু বিশেষ সুবিধা আছে, যা বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। প্রথমত, টানেলের অপর প্রান্ত, আনোয়ারায় ইতোমধ্যে কোরিয়া ইপিজেড গড়ে উঠেছে, যা অন্যান্য বিদেশী বিনিয়োগকারীর জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে। দ্বিতীয়ত, অঞ্চলটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের সন্নিকটে।

ফলে, এই অঞ্চলে স্থাপিত কোনো কারখানায় উৎপাদিত পণ্য তাৎক্ষণিক রপ্তানির জন্য জাহাজে উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ লিড টাইম একেবারে শূন্য। তৃতীয়ত, বন্দরের অতি নিকটে হওয়ায় অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচও অনেক কম হবে। এসব কারণে দেশের রপ্তানিকারকরাও এতদঅঞ্চলে ফ্যাক্টরি স্থাপনে আগ্রহী হবেন। সেই সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এই অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে দেশে পর্যাপ্ত বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ তো এমনিই আসবে না। এজন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ সুযোগ ধরে আনতে হবে। সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে কোন্ কোন্ খাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে এমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছেন। যেমনÑ এই মুহূর্তে ইলেকট্রিক ভেহিকেল, ইলেকট্রিক ভেহিকেলের ব্যাটারি, কম্পিউটার চিপস, স্মার্ট ফোন, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক আইটেম বিদেশী বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় খাত হতে পারে।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশকে বিদেশী বিনিয়োগের হাব হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই বিদেশী বিনিয়োগের জন্য ভালো সাড়া পাওয়া যাবে। অর্থাৎ বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যাতে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার সুযোগ পায়। অবশ্য ইলেকট্রিক ভেহিকেলের মানসম্পন্ন ব্যাটারি উৎপাদনে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারলে উন্নত বিশ্বেও ভালো রপ্তানির বাজার পাওয়া যাবে।
এক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার বড় ভূমিকা আছে। তবে শুধু রোড শো করে কিছুই হবে না। সরাসরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যার মধ্যে প্রথমেই নিজস্ব গবেষণা এবং যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বের সেই সকল বিনিয়োগকারীদের খুঁজে বের করতে হবে, যারা এমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে আগ্রহী। সেসব বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিতে হবে। এ রকম আগ্রহী সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই যে সবার কাছ থেকে সমান সাড়া পাওয়া যাবে, তেমন নয়। তবে সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারলে অনেকের কাছ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে।

এখানে একটি বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক, তা হচ্ছে সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতির নানা উত্তেজনাকর ঘটনার কারণে অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান, যাদের উৎপাদন ক্ষেত্র বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তারা সেগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশও এই সুযোগ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেরও ভালো ভূমিকা রাখার আছে। বিশেষ করে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ এবং সম্ভব হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে। বিশেষ করে যারা এসব বিনিয়োগকারীর প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন বা এসব বিনিয়োগকারীর সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
আরও একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে দেশের নির্মিত সব আধুনিক অবকাঠামোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। কারণ, ব্যাংকিং সুবিধা যদি আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি না হয়, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনা করতে সমস্যা হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তখন সমস্যার সম্মুখীন হবেন এবং লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না, যা প্রকারান্তরে বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। তাই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এই খাতের মান একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত নিতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। মোটকথা, বঙ্গবন্ধু টানেলকে কেন্দ্র করে বিদেশী বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

দেশের দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণ যেমন- যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তেমনি ব্যাংকিং খাতের মান উন্নয়ন করে দেশের আর্থিক লেনদেনের মানদণ্ড আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি, দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসকে স্বউদ্যোগে তৎপর হয়ে সম্ভাব্য এবং আগ্রহী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সরাসরি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে এই টানেলকে কেন্দ্র করে যে অপার বিদেশী বিনিয়োগ সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

সর্বশেষ - সকল নিউজ

আপনার জন্য নির্বাচিত