logo
Monday , 16 October 2023
  1. সকল নিউজ

চট্টগ্রাম বন্দর : রিজিওনাল পোর্টের পথে সম্ভাবনা

প্রতিবেদক
admin
October 16, 2023 9:41 am

বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রধান দ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এই বন্দর প্রাতিষ্ঠানিক বন্দর হিসেবেও ১৩৪ বছর অতিক্রম করেছে। দেশে আরও দুটি বন্দর থাকলেও আমদানি–রফতানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরতা বেশি।

সমুদ্রপথে দেশের আমদানি-রফতানি পণ্যের ৯৩ শতাংশ পণ্য হ্যান্ডলিং করছে চট্টগ্রাম। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি আর বিদেশে পণ্য রফতানির মাধ্যমে এই বন্দর দেশের কল-কারখানাসহ অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। এতদিন শুধু দেশের বন্দর হিসেবে পণ্য হ্যান্ডলিং করলেও এই বন্দরের সামনে উঁকি দিচ্ছে রিজিওনাল পোর্ট হওয়ার সম্ভাবনা। বন্দর সম্প্রসারণের যেসব প্রকল্প আছে তা বাস্তবায়ন শেষে বন্দর রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করবে।

বর্তমান সরকার বন্দরকে কেন্দ্র করে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিদ্যমান বন্দরগুলোর সম্প্রসারণকাজও এগিয়ে চলছে। বন্দর সুবিধা বাড়াতে টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকােবিলায় এসব প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। আবার রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে ভবিষ্যতে আশপাশের দেশের সম্ভাব্য পণ্য হ্যান্ডলিংয়েরও বিষয় মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। এই লেখায় বন্দর কীভাবে রিজিওনাল পোর্টে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং অর্থনীতিতে প্রভাব কেমন হবে তা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী তাও রয়েছে। তবে শুরুতে বন্দরের অতীতের অবস্থায় চোখ ফেরানো যাক।

অতীতকালে চট্টগ্রাম:
উপমহাদেশের প্রাচীন বন্দরগুলোর একটি চট্টগ্রাম বন্দর। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে এই বন্দর থেকে সমুদ্রযাত্রার কথা আছে ইতিহাসের পাতায়। এ হিসেবে দুই হাজার ৪০০ বছরের প্রাচীন বন্দর বলা যায় চট্টগ্রামকে। ভৌগলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রাচীনকালে এই বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছে বিদেশিরা। বন্দর দখলে রেখে আধিপত্য বিস্তার করেছে এ অঞ্চলে। সে সময় বন্দর অবকাঠামো বলতে তেমন কিছু ছিল না। বন্দর পোতাশ্রয় হিসেবে কাজ করেছে সে সময়।

ইংরেজ আমলে প্রাতিষ্ঠানিক বন্দরের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর অবকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৮৯৯ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে বন্দরে চারটি জেটি নির্মাণ হয়।

ইংরেজ আমলে কলকাতার গুরুত্ব ছিল বেশি। কারণ সে সময় শুরুর দিকে বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কাশিম বাজার ও হুগলী। এ কারণে আঠার ও উনিশ শতকে কলকাতা বাংলার প্রধান বন্দরে রূপান্তরিত হয়। চট্টগ্রাম দ্বিতীয় বন্দর হিসেবে স্থান পায়। চট্টগ্রাম বন্দরের নাম রাখা হয় চিটাগাং।

ভারত ভাগের পর ব্রিটিশ আমলের চারটি জেটি দিয়ে বন্দরের পথচলা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের একক বন্দরে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। পণ্য পরিবহন বাড়তে থাকায় সে সময় জেটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বন্দরের জেসিবি টার্মিনালের জেটিগুলো সে সময় সংস্কারে হাত দেয়া হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন পথচলা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর পর। মাইন পুঁতে অচল করে দেয়া বন্দরকে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। যেসব জেটি ছিল সেগুলোর অনেকগুলো ব্যবহার অনুপযোগী ছিল। এ জন্য জেটি সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। ১৯৭৭ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু হলে নতুন ধরনের পণ্যের জন্য নতুন অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন দেখা দেয়। এই ধারাবাহিকতায় প্রথম নির্মাণ হয় চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল বা সিসিটি। ১৯৯১ সালে এই টার্মিনাল ব্যবহার করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু হয়। এরপর ২০০৭–০৮ অর্থবছরে নির্মিত হয় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। এ সরকারের আমলে শুরু হওয়া পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষে চালুর অপেক্ষায় রয়েছে।

বন্দরের বর্তমান অবস্থা:

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। কারণ আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে লজিস্টিকস ও অবকাঠামোগত সুবিধা চট্টগ্রামের মতো অন্য কোথাও তৈরি হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীরা এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী বেশি। ব্যবসায়ীরা কোন বন্দর ব্যবহার করছে তার তথ্য দিয়েও চট্টগ্রামের গুরুত্ব বোঝা যায়।

বন্দরের হিসাব অনুযায়ী, সমুদ্রপথে দেশে আমদানি-রফতানি পণ্যের ৯৩ শতাংশই হ্যান্ডলিং হয় এই বন্দর দিয়ে। আর কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৯৮ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু প্রধান বন্দর নয়, কার্যত এককভাবে সমুদ্রপথে দেশের আমদানি-রফতানির বেশিরভাগই হ্যান্ডলিং হচ্ছে এই বন্দর দিয়ে।

ভৌগলিক সুবিধার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১২–১৩ থেকে ২০১৬–১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছরে ১৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনার পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে (২০১৭–১৮ থেকে ২০২১–২২) এই সংখ্যা বেড়ে বছরে গড়ে ২৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৪৬ শতাংশ।

কনটেইনার ছাড়াও বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিংও বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১২–১৩ থেকে ২০১৬–১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছরে তিন কোটি ৭৭ লাখ টন বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে (২০১৭–১৮ থেকে ২০২১–২২) পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বেড়ে বছরে গড়ে সাত কোটি টনে উন্নীত হয়েছে।

জাহাজ আগমনের হারও বেড়েছে। ২০১২–১৩ থেকে ২০১৬–১৭ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছরে দুই হাজার ৫৯২ টি জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে গড়ে বছরে তিন হাজার ৯৪২টিতে উন্নীত হয়েছে। গত বছর এই বন্দর দিয়ে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং করেছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ৩২ লাখ টিইইউএস।

বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাড়ার কারণ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি। ২০২১–২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৯ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে পণ্য রফতানি হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছরে আমদানি-রফতানি মিলে বৈদেশিক বাণিজ্যের আকার ছিল ১৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০–২১ অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের আকার ছিল ১০৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২০–২১ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার সবচেয়ে বেশি বহন করছে চট্টগ্রাম বন্দর।

তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে বাণিজ্যে ছন্দপতন ঘটিয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বিশেষ করে ডলার সংকোচন নীতির কারণে, তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহ করার ফলে, আমদানিতে কিছুটা ভাটার টান পড়েছে।

বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার একাই সামলালেও এই বন্দরের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর সরু চ্যানেল দিয়ে এই বন্দরে সর্বোচ্চ ১৯০ মিটার লম্বা এবং সাড়ে নয় মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যায়। কনটেইনার জাহাজ যেগুলো ভিড়ানো হয় সেগুলো মূলত ফিডার ভ্যাসেল। ছোট আকারের জাহাজ। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বড় জাহাজ ভিড়ানোর নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারিত প্রকল্প হিসেবেই সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে।

রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে বন্দরের সম্ভাবনা:

চট্টগ্রাম বন্দরের ভৌগলিক সুবিধার কারণে আশপাশের দেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্টেরও সুযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সহজ যোগাযোগ সুবিধা ব্যবহার করে ভারতের সাত রাজ্য, ভূটান, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনের ইউনান প্রদেশের পণ্য পরিবহনের বিষয়ে অনেকদিন থেকেই আলোচনা চলে আসছিল। গত এক দশকে ভারত, নেপাল, ভূটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তযোগাযোগ সংক্রান্ত কিছু চুক্তি হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরকে রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে যাত্রা শুরুর বিষয়ে প্রথমে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের কথা আসে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয় ২০১৮ সালে। পরের বছর এ পথে পণ্য পরিবহন পদ্ধতি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়। এই চুক্তি ও এসওপি’র আওতায় ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে একটি পরীক্ষামূলক চালান নেয় ভারত। ইস্পাত ও ভোগ্যপণ্যের চার কনটেইনারের একটি চালান জাহাজে করে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে এবং পরে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা ও আখাউড়া হয়ে আগরতলায় যায়। চুক্তির আওতায় সবকটি রুটে পণ্য পরিবহন হয়েছে। পরীক্ষামূলক শেষ চালানটি ভারতের মেঘালয় থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নেয়া হয়েছে। পরীক্ষামূলক চালান আনা-নেয়ার পর এখন আনুষ্ঠানিকভাবে পণ্য পরিবহন শুরুর অপেক্ষার পালা। চুক্তির আওতায় ছাড়াও ভারতের কয়েকটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে ট্রান্সশিপমেন্ট হয়েছে।

এর আগে নেপালের আমদানি পণ্য বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে নেপালে নেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভূটানও বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে। ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশটির সঙ্গে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি সই হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলো দিয়ে মালামাল পরিবহন করতে চায় ভূমি বেষ্টিত দেশ ভূটান। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা মাশুল ছাড়ের জন্য তারা দাবি করছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি সই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন–ভূটান চাইলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রাবন্দর এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়া আন্তঃদেশীয় পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধার্থে তারা চাইলে, বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে গুদামও তৈরি করতে পারে।
চীনের ইউনান প্রদেশও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে মিয়ানমারের রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয় সামনে আসায় চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আলোচনা স্তিমিত হয়ে গেছে। এরপরও সম্ভাবনা তৈরি হলে প্রতিবেশী দেশের পণ্য পরিবহনে অগ্রগতি হতে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তুতি:

পরীক্ষামূলক বা বিচ্ছিন্নভাবে হলেও রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে চট্টগ্রামের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। তবে বন্দরের বিদ্যমান কাঠামো ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশের পণ্য হ্যান্ডলিং বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ আমাদের নিজেদের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের চাপ আছে। দেশীয় পণ্যের চাপ সামলাতে বছরের অনেক সময় হিমশিম খেতে হয় বন্দরকে। রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে পণ্য পরিবহন বাড়লে চাপ বাড়বে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। সেজন্য দরকার নতুন নতুন টার্মিনাল ও অবকাঠামো।

এটি আশার কথা যে, একসময় অবহেলিত বন্দর উন্নয়নে গতি পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। এ সরকার বন্দর উন্নয়নে বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। মোংলায় নতুন টার্মিনাল হচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি প্রকল্প রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের। চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারিত প্রকল্প হিসেবে মাতারবাড়ী টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর গভীর সমুদ্রবন্দর না হলেও মাতারবাড়ী টার্মিনালের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপ নেবে চট্টগ্রাম। মাতারবাড়ীতে ১৬ মিটার ড্রাফটের চ্যানেল তৈরি হয়েছে। ২০২৫ সালে নির্মাণ শেষ হবে দুটি জেটির। ২০২৬ সাল থেকে মাতারবাড়ী থেকে সারাদেশে সড়কপথেও পণ্য পরিবহন শুরু হবে। এরপর ধাপে ধাপে সেখানে আরও জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বন্দরের।

বন্দরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাতারবাড়ী মূলত ট্রান্সশিপমেন্ট টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার হবে। বড় জাহাজ মাতারবাড়ী জেটিতে ভিড়বে। সেখান থেকে ছোট জাহাজে করে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রায় পণ্য নেয়া হবে। একইভাবে এসব বন্দর থেকে পণ্য এনে মাতারবাড়ীতে বড় জাহাজে করে বিদেশে রফতানি হবে। বড় জাহাজ ভিড়ানো হলে সরাসরি ইউরোপ–আমেরিকা থেকে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে এই টার্মিনালে জাহাজ ভিড়ানো যাবে। একইভাবে রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে মাতারবাড়ী থেকে ইউরোপ–আমেরিকায় জাহাজ সেবা চালুর সুযোগ তৈরি হবে।

মাতারবাড়ী শুধু অভ্যন্তরীণ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরই হবে না, আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে রূপ নিতে পারে। কারণ মাতারবাড়ীতে মাদার ভেসেল জেটিতে ভিড়তে পারবে। মিয়ানমার, ভারতের সাত রাজ্যসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের সুযোগ রয়েছে।

আবার বে টার্মিনাল নামে বড় প্রকল্পের বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বন্দর আপাতত ২০২৬ সালে এই টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্রেক ওয়াটার, চ্যানেল ও টার্মিনাল নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বে টার্মিনালের কাজও।

এই দুটো টার্মিনাল নির্মাণ হলে দেশীয় কার্গো পরিবহনের পরও সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকবে। কারণ বে টার্মিনালের সক্ষমতা বন্দরের দুইগুণের বেশি হবে। রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে পরিণত করা গেলে বন্দরের সক্ষমতা যেমন ব্যবহার হবে তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাধা অপসারণ করতে হবে:

রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে পরিণত করতে হলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে হবে না। দরকার হবে সিঙ্গাপুর, কলম্বোর মতো পেপারলেস ট্রেড। বন্দরে অনেকদিন ধরে এ নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম চলছে।

কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি সিটিএমএস চালু হয়েছে। নতুন নতুন মডিউল যুক্ত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ইলেকট্রনিক ডেলিভারি যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ঘরে বসে অনলাইনে ইলেকট্রনিক ডেলিভারি পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। এতে জাল ডেলিভারি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

তবে বন্দর সেবার অনেক কিছু অনলাইনে করা গেলেও বন্দর সংশ্লিষ্ট অনেক কাজের জন্য সশরীরে দৌঁড়াতে হয়। যেমন, শিপিং খাতে কাস্টমস, শিপিং অফিস, নৌবাণিজ্য অফিস, আয়কর, বন্দর, পোর্ট হেলথ ও সি ইমিগ্রেশনে নটিফাই ও অনুমোদন নিতে হয়। আবার পণ্য খালাসের জন্য কোয়ারেনটাইন অফিস, বিএসটিআইসহ পণ্যভেদে বিভিন্ন সংস্থার কাছে যেতে হয়। এসব সেবা যাতে এক ছাদের নিচে পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

বন্দর থেকে পণ্য খালাসের বর্তমানে যে সনাতন পদ্ধতি রয়েছে তা নতুন টার্মিনালগুলোতে রাখা কোনোভাবেই উচিত হবে না। বন্দরের মূল জেটির পাশে এখন কনটেইনার খুলে পণ্য ডেলিভারি হয়। এটি বিশ্বের কোথাও নেই। আবার এলসিএল পণ্যের ব্যবস্থাপনাও করে বন্দর। এটি পুরোপুরি বেসরকারিখাতে ছেড়ে দেয়া উচিত।

বহু আগে থেকেই আমরা বলে আসছি, সিঙ্গাপুরের মতো ডিস্ট্রিবিউশন পার্ক গড়ে তোলার। বন্দর কর্তৃপক্ষ ডিস্ট্রিবিউশন পার্ক গড়ে তুলবে। ভাড়া দিবে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের কাছে। নতুন টার্মিনালগুলোর একপাশে জেটির বাইরে সংরক্ষিত এলাকায় এটি করা যেতে পারে। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের হাতে এ দায়িত্ব তুলে দেয়া যায়। সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় এই কাজের জন্য কাস্টমস থেকে আলাদা করে জায়গার জন্য অনুমোদন নিতে হবে না। পূর্ণাঙ্গ সেবা দেয়া সম্ভব হবে।

আবার রাজস্ব প্রশাসনকেও এগিয়ে আসতে হবে। রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করতে হলে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।শুধু রিজিওনাল হাব হিসেবে পরিণত করতে নয়, দেশীয় বাণিজ্যকে সুবিধা দিতে এসব সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে হবে।

অগ্রাধিকার কাজ:

চট্টগ্রাম বন্দরের যে দুটি বড় প্রকল্প রয়েছে তা নির্মাণ শেষ হলে নতুন যুগের সূচনা হবে। এই দুটি বড় প্রকল্প ঘিরে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় সুযোগ আসছে সামনে। এ জন্য সরকারের নীতি সহায়তা দেয়া উচিত। কারণ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি বন্দর পরিচালনা থেকে শুরু করে বন্দরে সংশ্লিষ্ট কাজে সুযোগ দেয়া হয় তাহলে রাজস্ব দেশেই থাকবে। এখন প্রশ্ন হল দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সেই সক্ষমতা আছে কি–না?

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এখন দেশীয় ১৩টি প্রতিষ্ঠান জেটি ও টার্মিনাল পরিচালনা করছে। অর্ধশত বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে তেমনি দুই দশকের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান যৌথ বা একক বিনিয়োগে বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনায় সক্ষম হয়ে উঠছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌথ বিনিয়োগে সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে। শুধু জেটি ও টার্মিনাল পরিচালনাই নয়, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ২০টি বেসরকারি ডিপো পরিচালনা করছে। শুষ্ক বন্দর হিসেবে পরিচিত ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোও বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার সুযোগ রয়েছে। কারণ জাহাজ থেকে কনটেইনার ও পণ্য হ্যান্ডলিং ছাড়া বন্দরকেন্দ্রিক সব কার্যক্রমও করে থাকা তারা। সরকারি নীতি সহায়তায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সক্ষম করে তুলছে।

তবে এটা ঠিক, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিদেশি অপারেটরদেরও সুযোগ দিচ্ছে। বে টার্মিনালে নতুন তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বন্দরের। একটি চট্টগ্রাম বন্দর নির্মাণ করবে। বাকি দুটি নির্মাণ করবে দুটি বিদেশি অপারেটর। বিদেশি অপারেটর বিনিয়োগ করে বে টার্মিনালের দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।তিন জেটির পতেঙ্গা টার্মিনালে যন্ত্রপাতি ছাড়া প্রায় এক হাজার দুইশত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বন্দর।এই টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে।

শেষ কথা:

বন্দর কার্যক্রমে রাজস্ব আয় ছাড়াও বন্দর সহায়ক প্রচুর কার্যক্রম তৈরি হয়। পুরো কার্যক্রম লজিস্টিক খাত হিসেবে ধরা যায়। এই খাতের মধ্যে রয়েছে পরিবহন, পণ্য সংরক্ষণাগার, বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর সেবাসমূহ। এই খাতের সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো হল বন্দর, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, ডিপো পরিচালনাকারী ও পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লজিস্টিকস কোম্পানিগুলো। দেশে এখন এসব খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত দেশীয় অভিজ্ঞ জনবল। বন্দর কার্যক্রম বাড়ার সঙ্গে এসব খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে। দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। তারা বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের চাপ সামাল দিচ্ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লে দক্ষ জনবলের সংখ্যাও বাড়বে। ভবিষ্যতে দেশ থেকে দক্ষ জনবল রফতানির সুযোগ তৈরি হবে।

দেখা যাচ্ছে, রিজিওনাল পোর্ট হিসেবে যাত্রা শুরু এখন সময়ের ব্যাপার। নতুন বন্দর ও টার্মিনালগুলোর কাজ শেষ হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বন্দরের কার্যক্রমের আওতা সামনে বাড়বে। এসব কার্যক্রম অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে যদি দেশীয় জনবল ও প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়।

পাশাপাশি লজিস্টিকস খাতে দক্ষ জনবলের চাহিদা বাড়বে সামনে। দক্ষ জনবল যেমন দেশের লজিস্টিক খাতের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। বিদেশ থেকে কর্মী আনতে হবে না। আবার দক্ষ জনবল যত বাড়বে ততই বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানির পথও সুগম হবে। রেমিট্যান্স আয়েও প্রভাব পড়বে। বন্দর সেবার আওতা বাড়াতে এখন দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হলে বিদেশি কর্মীর চেয়ে দেশীয় কর্মী নিয়োগে প্রাধান্য দিতে হবে।

সর্বশেষ - সকল নিউজ