logo
Tuesday , 21 March 2023
  1. সকল নিউজ

অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে ঢাকা

প্রতিবেদক
admin
March 21, 2023 10:05 am

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত বছরের ৩১ মে মো. নজরুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার পর থেকে পাঁচ বছর পলাতক থাকা আসামি নজরুল গত বছরের ৩ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। এর কয়েকদিন পর ১৯ জুন রাজধানীর উত্তরা থেকে র‌্যাবের হাতে আটক হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রেখে হত্যাচেষ্টা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি শেখ মো. এনামুল হক।

রাজধানী ঢাকা থেকে এমন বহু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে নিয়মিত গ্রেফতার করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ধরনের ঠিক কতজন আসামিকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে তার তথ্য পাওয়া যায়নি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে। তবে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক বছরে এ ধরনের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক প্রায় হাজারখানেক আসামিকে রাজধানী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র‌্যাবের শুধু একটি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে তারা ৯৭ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে গ্রেফতার করেছে। অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা থেকে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেফতারের বিষয়ে আমাদের বিশেষ নজরদারি থাকে। আমরা চুরি, ছিনতাই, মাদকের সাজাপ্রাপ্ত আসামি থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামিও গ্রেফতার করেছি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ২০২২ সালের অপরাধ চিত্রে দেখা যায়, ২০২২ সালে রাজধানীতে বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, পলাতক, অভিযুক্তসহ ৬১ হাজার ৪৯৪ জন আসামি গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ হাজার ৫৬৩ জন আসামি গ্রেফতার করা হয় পুলিশের গুলশান বিভাগ থেকে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক, ধর্ষণ, নারী নিযার্তনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

বিভিন্ন ধরনের অপরাধে গত বছর রাজধানীতে মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য, মাদক ও চোরাচালানের। এ ধরনের মামলা ১৬ হাজার ৪০০টি। নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৬০৭টি। বিভিন্ন ধরনের চুরির মামলা ১ হাজার ৬০৩টি, অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্য ধরনের মামলা ৬ হাজার ৪৫৭টি। অর্থাৎ, গত বছর সারাদেশে যত অপরাধ হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংগঠিত হয়েছে রাজধানীতে।

জঙ্গিদের জন্যও অনেকটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল রাজধানী। এখানে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গি কার্যক্রম চালায় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মালিবাগে গোপন বৈঠকে মিলিত হওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) খুলনা বিভাগের দুই নেতা আব্দুল কুদ্দুস ও মো. সিরাজুল ইসলাম ওরফে সালাউদ্দিনকে। এছাড়া দেশে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নায়েবে আমির মো. মহিবুল্লাহ ওরফে ভোলার শায়েখকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

রাজধানীতে অপরাধীদের আনাগোনা ও অবস্থানের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, অপরাধীরা যে কোনো জায়গায় পালিয়ে থাকতে চাইবে, আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। কখনো পালিয়ে থাকছে কখনো ধরা পড়ছে। যারা অপরাধী যেখানেই থাকুক না কেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

 

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীতে অপরাধ বেশি বলার সঙ্গে এটাও বলতে হবে এখানে বেশি লোক থাকে। ঢাকা শহরে যত লোক থাকে অন্য বিভাগীয় শহরে তত লোক নেই। সেজন্য এখানে অপরাধও বেশি। জীবিকা বা কাজের তাগিদে মানুষ এখানে আসে। গ্রামে একজন গেলে কে আসছে এটা পুরো গ্রাম জানে, আর এখানে পাশের বাসায় কে থাকে মানুষ খবর নিতে চায় না।

‘জনবহুল হওয়ার কারণে অপরাধীদের আত্মগোপনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে উপযোগী জায়গা রাজধানী। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা আগের তুলনায় বেশ ভালো। আগে রাতে পুরো ঢাকায়ই ছিনতাইকারীর কবলে পড়তো মানুষ। এখন কিছু এলাকা ছাড়া তেমনটা দেখা যায় না।’

রাজধানীতে অধিকাংশ মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে অবস্থান করে। দুই কোটি মানুষের শহরে অপরাধীরা যেমন সহজে বিচরণ করতে পারে আবার তারা পরিচয় গোপন করেও এখানে থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, অপরাধ যারা করে তাদের লক্ষ্য আছে। তাদের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুযোগ রাজধানীতে বেশি। তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে অর্থ। অর্থ বা টাকার কেন্দ্রবিন্দু হলো রাজধানী। তারপর এখানে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। এই দুই কোটি মানুষের মধ্যে তারা পানিতে যেমন মাছ ভেসে বেড়ায় অপরাধীদের জন্যও অনেক সহজ হয় এখানে মাছের মতো ভেসে বেড়াতে।

‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তাদের খুঁজে পাওয়া কষ্ট হয়। কিন্তু গ্রামে সেটা হয় না। যে অপরাধ করবে গ্রামের অধিকাংশই সেখানে তাকে চিনে ফেলে। কিন্তু এখানে কে অপরাধ করলো আমরা কিছুই জানি না। ফলে অপরাধীরা রাজধানী বেছে নেয়। তারা মনে করে এখানে অপরাধ করে পার পাওয়াটা সহজ। সহজে তাদের চিহ্নিত করতে পারবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীতে অধিকাংশ মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে অবস্থান করে। ফলে গ্রামের মানুষের যেমন একে অপরের পরিচিতি থাকে এখানে এটা থাকে না। যারা অপরাধ করে বা করতে চায় তারা পরিচয় গোপন করেও এখানে থাকতে পারে বলে নিজেদের জন্য অনেকটা নিরাপদ মনে করে ঢাকা।

‘নগরীতে শৃঙ্খলা না থাকা, অপরাধীরা এক ধরনের আশ্রয় পাওয়াসহ রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজ থেকে কোনো ধরনের তৎপরতা না থাকায় নানা ধরনের অপরাধ ও অপরাধীরা অবস্থান করছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন নগরীর শৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা, রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের তৎপরতা ও যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অপরাধ করে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা। নয়তো অনেকে অপরাধ না করেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, যা জঙ্গিরা অনেক সময় করে।

সর্বশেষ - সকল নিউজ