উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক


admin প্রকাশের সময় : জুলাই ১০, ২০২৪, ৩:২৫ অপরাহ্ন | 746
উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক দশক পর চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ৮ জুলাই চীনের রাজধানী বেজিংয়ের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। তাঁর এই রাষ্ট্রীয় সফর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট জাতিতে রূপান্তরের লক্ষ্য পূরণের জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আলোচনার নতুন আশার সঞ্চার করেছে। চীন সরকারও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে উচ্চ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে। শেখ হাসিনা ও শি জিন পিংয়ের দ্বিপক্ষীয় এই বৈঠককে স্মরণীয় করে রাখতে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন খাতে বিশটি সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অর্থনৈতিক ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি এবং পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষণীয় যে, চীন মানসম্মত উচ্চশিক্ষা, উচ্চতর গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। চীনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করেছে। সম্পাদিত গবেষণা কার্যক্রম বিশ্ব জ্ঞান ভা-ারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, সবুজ প্রযুক্তি ও বংশগত বিষয়ক প্রকৌশল (জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং) ইত্যাদির প্রযুক্তিগত উন্নয়নে চীন বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও চীনের অগ্রগতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। যেখানে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ গত চার দশকে দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং শিক্ষা সম্প্রসারণে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ পৌনে দুইশত পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করেছে।

কিন্তু উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিউএস র‌্যাঙ্কিং, টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিং অথবা সাংহাই র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচশততেও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই পাঠদানমুখী, সেহেতু উদ্ভাবন ও গবেষণার র‌্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নি¤œমুখী। একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে গুণগত শিক্ষা, গবেষণার ফল এবং উদ্ভাবনের ওপর গুরত্বারোপ করতে হবে।

যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং রপ্তানি সম্ভব হতে পারে। যেহেতু চীন এসব ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, সেহেতু বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে কার্যকর অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করতে পারে। এ প্রেক্ষিতে গুণগতমানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা, উচ্চতর গবেষণা, উদ্ভাবন এবং বিশেষ করে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে পারে।
চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু এবং দীর্ঘদিনের উন্নয়ন অংশীদার। চীন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যার ধারাবাহিকতায় দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১৬ সালে শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ‘কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারিত্বে’ উন্নীত হয়। উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সম্মেলনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা ইত্যাদির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে কিভাবে চীন বাংলাদেশের উন্নয়নের সহাযোগী হতে পারে, তা আলোচানায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেতে পারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ একশত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চীনের দশটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চীনের প্রাথমিক, বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাও বিশ্বমানের। চীন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং ডিপ্লোমা, ডক্টরাল ও পোস্ট ডক্টরাল শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন মেয়াদে বৃত্তি ও ফেলোশিপ প্রদান করছে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী ১৪,০০০-এর বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষায়তনে অধ্যয়ন ও গবেষণা করছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন অংশীদারিত্ব প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও গবেষণার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
একুশ শতকে জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে টিকে থাকা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে উচ্চশিক্ষা বিশেষত উচ্চতর গবেষণা অনস্বীকার্য। আমরা যদি বিশ্ব অর্থনীতির দিকে তাকাই তাহলে দেখব, যে দেশে উচ্চশিক্ষার হার, দক্ষ জনশক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি বেশি, সে দেশ ও জাতি সর্বক্ষেত্রে ততই বেশি এগিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন জ্ঞান সৃজন, ধারণ এবং তা অংশীজনদের মাঝে বিতরণ। বৈশ্বিক চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণায় অধিকতর গুরুত্বারোপ, গবেষণালব্ধ ফল বাণিজ্যিকীকরণ ও বিশ্বের জ্ঞান ভা-ারে তা সংযোজন করা আজ সময়ের বাস্তবতা।
বিশ্বায়নের এ যুগে মেধার কোনো বিকল্প নেই। মেধাস্বত্ব আধুনিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমকে যথাযথভাবে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। মানবজাতির অগ্রগতি এবং সার্বিক কল্যাণনির্ভর করে প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক জগতে নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষমতার ওপর। এ জাতীয় নতুন সৃষ্টিকর্মগুলোর আইনি সুরক্ষা প্রয়োজন। মেধাসম্পদের প্রসার ও সংরক্ষণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে, নতুন কর্মক্ষেত্রের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে। বিশ্বের অনেক দেশ একমাত্র মেধাসম্পদকে পুঁজি করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে সুদৃঢ় করেছে।

উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষকদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষকতার পাশাপাশি নতুন জ্ঞান সৃজনে মৌলিক ও উদ্ভাবনীমূলক গবেষণা কর্মকা-ে বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের গবেষণা কর্মকা-ের মাধ্যমে নতুন আবিষ্কার/উদ্ভাবন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গবেষণালব্ধ ফল প্যাটেন্ট হলে একদিকে যেমন গবেষকের সুনাম ও মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও গবেষক উভয়ই আর্থিকভাবে উপকৃত হবে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীনের গবেষকরা যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী হতে পারেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ধরনের কার্যক্রমকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যৌথ কর্মশালা, সেমিনার, ডায়ালগের আয়োজন করতে পারে এবং যৌথ একাডেমিক গবেষণা কার্যক্রমের সমন্বয় করতে পরে।
উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষতমান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নবতর জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচন, উচ্চশিক্ষাকে আধুনিকায়ন, বিষয়ে বৈচিত্র্য আনয়ন ও বিশ্বমানের গবেষণা নিশ্চিতকরণসহ বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুসংহতকরণে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক ও গবেষকগণের সৃজনশীল ও গবেষণা কর্মকা- যথানিয়মে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক অনুমোদিত Strategic Plan For Higher Education in Bangladesh: ২০১৮-২০৩০-এর অ্যাকশন প্ল্যান-৩১-এর অধীনে Supporting PhD and Nwe Researchers-এর আওতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞান ও যোগ্যতাসম্পন্ন বিশ্বমানের শিক্ষাবিদ ও গবেষক তৈরির উদ্দেশ্যে চীনের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সম্প্রতি Belt and Road Chinese Center (BRCC)-এর উদ্যোগে চীনের খ্যাতনামা ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।

কমিশন ও বিআরসিসির যৌথ উদ্যোগে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য মেধাস্বত্ব লালন, সংরক্ষণ এবং তা যথাযথ চর্চার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এতদসংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং খ্যাতনামা চীনা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশাল প্রত্যাশা সঞ্চার করেছে। ভূরাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, সুনীল অর্থনীতির জন্য সামুদ্রিক জৈব সম্পদ ব্যবহার, টেকসই খাদ্য, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং পরিবেশের ওপর উন্নত গবেষণায় অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার বিষয়টি প্রতিভাত হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।