বড় দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কে


admin প্রকাশের সময় : জুন ২৫, ২০২৪, ৯:২৯ পূর্বাহ্ন | 704
বড় দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কে

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য সামনে আসায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন আতঙ্কে আছেন। কখন কার আমলনামা গণমাধ্যমে উঠে আসে—সেই আশঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। অপকর্মের তথ্য ফাঁস হওয়া ঠেকাতে অনেকেই অধীনস্থ কর্মচারীদের সমীহ করে চলছেন। পুলিশ, কাস্টমস ও প্রশাসনের পাশাপাশি প্রকৌশল সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্যাডারেও এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব কালবেলাকে বলেন, বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ নিয়ে দেশের মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ। শুধু ঊর্ধ্বতন নয়, সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত। ফলে একজনের দুর্নীতি ধরা পড়লে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়। তবে এবারের মতো এত বড় দুর্নীতি আগে কখনো প্রকাশ হয়নি। ফলে সাধারণ কর্মচারীরাও মহা টেনশনে আছেন। কে কখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন—অনেকেই সেই শঙ্কায় আছেন। অনেকেই গণমাধ্যম নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন।

তারা আরও বলেন, দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় সাধারণ মানুষ সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর কেউ সম্মান করছেন না।

সামনাসামনি সমীহ করলেও মানুষ মনে মনে সরকারি কর্মচারীদের ঘৃণা করছেন। সামাজিকভাবে সম্মানহানি হচ্ছে সব চাকরিজীবীর। এ কারণে তুলনামূলকভাবে সৎ কর্মকর্তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

কর্মকর্তাদের দাবি, প্রশাসনের সবাই দুর্নীতিবাজ নন। দেশে ভালো ও সৎ কর্মকর্তাও আছেন। দুর্নীতিবাজদের কারণে তারাও এখন কোণঠাসা।

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘দুর্নীতি পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তবে বাংলাদেশের দুর্নীতি অন্যান্য দেশকে হার মানিয়েছে। সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতির বড় বড় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিছু কিছু কর্মকর্তার সীমাহীন দুর্নীতির কারণে দেশ ও সমাজের মানুষ এখন আর সরকারি চাকরিজীবীদের বিশ্বাস করেন না। সম্মানও করেন না। বরং দেখলেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চান।’

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক এই রেক্টর বলেন, ‘প্রতিদিন আমি ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যাই। আমার হাঁটার সাথীরা জিজ্ঞেস করেন, ঢাকায় আমার নিজের বাড়ি আছে কি না। আমি তাদের বলি, আমার নিজের বাড়ি থাকবে কী করে? আমি সাত বছর সরকারের সচিব ছিলাম। আমার স্ত্রীও সরকারি চাকরি করেছেন। আমরা যে বেতন-ভাতা পেয়েছি, তা দিয়ে ঢাকায় বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব ছিল না। আমরা ভাড়া বাসায় থাকি। কিন্তু কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে আমার মতো লোকের কথাও তারা বিশ্বাস করতে চান না। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের কারণে প্রশাসনের সৎ কর্মকর্তাদেরও এখন কেউ বিশ্বাস করছেন না। সম্মান তো দূরের কথা।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম সাহস দেখিয়ে যে ভূমিকা পালন করছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। গণমাধ্যমের এ ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ যে কোনো মূল্যেই দুর্নীতি বন্ধ হওয়া উচিত।’

বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর পর বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমানের দুটি ঘটনা সামনে আসায় পুলিশ, কাস্টমস এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যেই বেশি অস্থিরতা ও আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে প্রকৌশল-সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরাও আতঙ্কে আছেন। কারণ এসব সংস্থায় দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সাব-রেজিস্ট্রার পদের কর্মকর্তারা সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়িত। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। দশম গ্রেডের (দ্বিতীয় শ্রেণি) সাব-রেজিস্ট্রার পদকেই টাকার খনি মনে করা হয়।

মাঠ প্রশাসনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলার পুলিশ সুপারসহ (এসপি) মাঠপর্যায়ের সব স্তরেই অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। এসব কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে শোনা যায়। বড় বড় কর্তাদের দুর্নীতির বিষয় ফাঁস হওয়ায় মাঠের কর্তারা উদ্বিগ্ন।

এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের পুত্র ইফাতের ছাগলকাণ্ডের পর তার অবৈধ সম্পত্তির ফিরিস্তি বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে মতিউরকে তার পদ থেকে প্রত্যাহার করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যদিও এর আগেই মতিউর দেশ ছেড়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

জানা গেছে, মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসায় কাস্টমসের (শুল্ক) বিভিন্ন স্তরে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সবাই নিজেকে রক্ষার কৌশল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

কর্মকর্তারা বলেন, দেশ যত বেশি ডিজিটাল হবে ততই দুর্নীতিবাজদের অপকর্ম বেরিয়ে আসবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণেই মতিউর কিংবা বেনজীরের অপকর্ম সহজে বের হয়ে এসেছে। সরকারের সব কাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো গেলে দুর্নীতি কমে আসবে।

কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘যারা ক্যাডার হয়েছে কিংবা সরকারি চাকরি পেয়েছেন, তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। লাখ লাখ প্রার্থীর মধ্যে হাতে গোনা কিছু লোক সরকারি চাকরি পান। সুতরাং রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এ ছাড়া যারা প্রশাসনের শীর্ষ পদে যান, তাদেরও সততার পরীক্ষা দেওয়া জরুরি। কারণ সবাই শীর্ষ পদে যেতে পারেন না।’