‘জি বি হোসেন বনাম দুদক এবং অন্যান্য’ মামলার শুনানিতে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এসব প্রশ্ন রাখেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১৯ সালে এই জি বি হোসেনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। সেই নিষেধাজ্ঞার আদেশ চ্যালেঞ্জ করে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট তাকে বিদেশ যেতে অনুমতি দেন। পাশাপাশি রুল জারি করেন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি এই রুলের শুনানি চলছিল। ওই দিন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘বিদেশে সম্পদ কেনার উৎসব’ শিরোনামে প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে তিন আইনজীবীর কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখেন হাইকোর্ট।
এসব প্রশ্নে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান, মনজিল মোরসেদ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিকের বক্তব্য চাওয়া হয়। সে ধারাবাহিকতায় সোমবার বিষয়টি শুনানির জন্য উঠলে একে এক তিন আইনজীবীই আদালতে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন আসামি জি বি হোসেনের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজলও।
শুনানিতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘বিদেশে অর্থ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা নির্দেশনা আছে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দেশের পাঁচ বছরের ভিসা পান তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যেতে পারবেন সে দেশে। আর এক বছর, ছয় মাস বা তার চেয়ে কম সময়ের জন্য ভিসা পেলে ১০ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া আর কোনো বৈধ উপায় নেই টাকা নিয়ে যাওয়ার।’
দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া হয়ে পরে এ টাকা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এই আসামিরও (জিবি হোসেন) দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে টাকা তিনি বিদেশে স্থানান্তর করেছেন।’
এ বক্তব্য শুনে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘এই দেশটা কি হরিলুটের জায়গা? উনি তো দ্বৈত নাগরিক। তিনি কি এভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন? দ্বৈত নাগরিকদের হার্ট (হৃদয়) তো দুই ভাগে বিভক্ত। কারণ তারা দুই দেশের নাগরিক। ঋণের টাকা বিদেশে নিয়ে গেলে সেটা এ দেশে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও সে দেশে সেটা অপরাধ নাও হতে পারে।’
তখন দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘একদম ঠিক, সেটাই তো হচ্ছে। তবে বিশ্বের কোনো দেশই অনুমোদন দেয় না যে, যেভাবে পারো দেশ থেকে টাকা নিয়ে আসো। গত এক বছরে কানাডাও তাদের আইনে পরিবর্তন এনেছে। ফলে এখন ইচ্ছেমতো বাড়ি কেনা যাচ্ছে না সে দেশে।’
তিনি বলেন, ‘কুয়েতে বাংলাদেশের এমপি পাপুলের সাজা হয়েছে। কুয়েতি দূতাবাস এরপর অনেক কাজ করেছে এই ইস্যুতে। ফলে সে দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্থ আসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছর ওই দেশ দেশ থেকে সব টাকা এসেছে ব্যাংকিং চ্যানেলে।’
এ নিয়ে কাজ চলছে জানালে খুরশীদ আলম খানকে উদ্দেশ করে বিচারপতি বলেন, ‘কত দিন ধরে কাজ চলবে? আমরা শুধু শুনেই যাচ্ছি কাজ চলছে।’
মামলার বিষয়বস্তুর বাইরে জি বি হোসেনের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘শুধু সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে বাধ্যবাধকতা আছে। সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে এমন কোনো নাগরিক যদি আমাদের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান তবে তাকে সেই দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হবে।’
এ সময় তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের উদাহরণ টানেন। বিএনপির এই নেতা আমেরিকার নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
এরপর নাগরিকত্ব, নাগরিকত্বের প্রকার, নাগরিকত্বের আইনি বিধি-বিধান, প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘১৯৮৪ সালের আগে বিয়ে করে ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকত্ব লাভ করার প্রচলন ছিল। ১৯৮৪ সালের পর অনেক দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ মেলে। তখন থেকেই দেশের টাকাপাচার বা স্থানান্তরের প্রবণতাটা বাড়তে থাকে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় যখন ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ হচ্ছে তখন থেকে লুটপাট শুরু হয়েছে। আর এই লুটপাটের টাকা দিয়েই বিদেশে কেউ বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব অর্জন করছেন। বাড়ি কিনছেন। আদালত এ বিষয়ে একটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করতে পারেন।’
এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের অর্থ বিদেশে পাচার নিয়ে ওই ব্যাংকের বক্তব্য শোনা উচিত আদালতের। কেন তারা একজন দ্বৈত নাগরিককে এত টাকা ঋণ দিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বক্তব্য আদালত শুনতে পারেন। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নির্দেশনা বা নীতিমালা রয়েছে কি না দ্বৈত নাগরিকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পর্শকাতর উল্লেখে করে আদালতের আদেশের আগে এ নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া উচিত বলে মত দেন। পরে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য শোনার তারিখ রেখে সে পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।