logo
Wednesday , 3 August 2022
  1. সকল নিউজ

আমানতকারীদের ওপর মূল্যস্ফীতির আঘাত

প্রতিবেদক
admin
August 3, 2022 9:36 am

জমানো টাকা ব্যাংকে আমানত হিসেবে রেখে তার সুদ দিয়ে যারা সংসার চালান তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। অস্বাভাবিক হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় এবং সুদের হার কমে যাওয়ায় বছর শেষে দেখা যাচ্ছে তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা প্রকৃতপক্ষে কমে গেছে। এক বছর মেয়াদে ১ লাখ টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে আমানতকারী যে পরিমাণ সুদ পাচ্ছেন; নির্ধারিত সময় শেষে ঐ সুদসহ টাকা দিয়েও আগের সময়ের যে কোনো সেবা ও পণ্য কেনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অর্থাৎ সুদের টাকায় পণ্য ও সেবা কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে তাদের। যারা শুধু সুদ আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তারা সুদের হার কমে যাওয়া ও খরচ বেড়ে যাওয়ার কষ্ট ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে তাদের আমানতের সুদের টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদের হার বেশি থাকা উচিত। নইলে সাধারণ আমানতকারীরা বিপাকে পড়েন। এখন ঠিক তা-ই হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। খেলাপি ঋণের ধাক্কা সামলিয়ে ব্যাংকের পক্ষে ওপরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।

আমানত বাড়ছে, কমছে প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা

কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ দুই বছর পরে কমলেও তারপর শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা আছে, এমন প্রায় সব ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বেড়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ। বাংলাদেশও এই বাইরে থাকতে পারেনি।

বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের কর। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা অনেক মানুষের আবার গরিব হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের আমানত ছিল ১৫ লাখ ১২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। করোনার সময়েও সে আমানত বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন করোনা শুরু হয়, তার তিন মাস পর একই বছরের ৩০ জুন ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; ঠিক এক বছর আগে যা ছিল ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা; অর্থাৎ ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা বেড়েছে। সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, বছরে গড়ে ১ লাখ কোটি টাকা করে আমানত বাড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে সুদনির্ভর পরিবারগুলোর এখন খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। সুদ হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পর ক্ষুদ্র আমানতকারীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সঞ্চিত যৎসামান্য টাকা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাংকে রাখেন। কিন্তু সুদ এত কম যে তাদের টাকা কমে যাচ্ছে। ফলে সাধারণের সঞ্চয়ের অভ্যাস কমে যাচ্ছে। এসব লোকের সম্পদ বলতে বোঝায় নগদ টাকা। এদের গাড়ি ও বাড়ি নেই। টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় তাদের ওপরও প্রভাব পড়ছে।

তিনি বলেন, ৬ শতাংশে আমানত রেখে তারা টিকে থাকতে পারবে না। আমানতের সুদ ৭-৮ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। তবে আমানত এবং ঋণের সুদ হারের ব্যবধান যেন বেশি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাংকের বাইরে তাদের যে ছোট বিনিয়োগ, অন্য কোথাও খাটাবেন, সে উপায়ও নেই। তারা যে জমি কিনবেন, শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ করবেন, তাও সম্ভব না। কারণ শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো নয়। সুদনির্ভর পরিবারগুলো একটি দুষ্ট চক্রে আটকা পড়েছে বলে মনে করেন সাবেক এ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ। রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ দেখা দিয়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ডলারের সরবরাহ সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় মুদ্রা টাকা চাপের মধ্যে রয়েছে।

সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ

অর্থনীতির বিশ্লেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশেরও এটা করা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে পারে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পলিসি করছে সেটা বড় লোকদের জন্য সহায়ক। যারা ঋণ নেবেন তাদের জন্য। ছোটদের ওপর খেয়াল রাখতে। সুদের হার নয়-ছয় থেকে বের হয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি রাখার নির্দেশনা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতে গড় আমানতে সুদ দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ০২ শতাংশ। আর ঋণের সুদ ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যারা দরিদ্রসীমার ওপরে ছিল তারা এখন এ সীমার নিচে নেমে গেছেন। কারণ তাদের সঞ্চয় নেই, যা দিয়ে তারা জীবনযাত্রার মান রক্ষা করবেন। আর যারা দরিদ্রসীমার নিচে ছিল তারা আরো সংকটে পড়েছে। আবার ব্যাংকে যে মানুষ সুদনির্ভর আয় করে তাদের আয় নেতিবাচক হয়ে গেছে। কারণ ব্যাংক এখন সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শতাংশ আমানতের সুদ দিচ্ছে। আবার মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশ, মানে যে ব্যাংকে টাকা রাখছে সে তার মূলধন হারাচ্ছে। এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকে সুদের হারের ওপরে যে নিয়ন্ত্রণ সে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে হবে। যাতে করে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার বাড়াতে পারে। আর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ আছে তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা, যাতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেওয়া যায়।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, সুদের হার মূল্যস্ফীতির সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। মেয়াদি আমানতের সুদের হার গত তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির নিচে হতে পারবে না। জাতীয় পর্যায়ের মূল্যস্ফীতি আর ব্যক্তি পর্যায়ের মূল্যস্ফীতি এক রকম নয়। নিম্ন আয়ের পরিবার তারা খাদ্য কিনতে বেশি ব্যয় করেন। তাদের জন্য খাদ্য মূল্যস্ফীতিটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। সেখানে খাদ্যমূল্যস্ফীতি যদি ৮ শতাংশ থাকে আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি যদি সাড়ে ৭ শতাংশ থাকে তাহলে সুদের হার বাড়বে সাড়ে ৭ শতাংশ।

২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দেয়। ব্যাংকের তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ হার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। সরকারি হিসাবে এখন জুন মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের বেশি। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের পলিসিগুলো গরিববান্ধব নয়, বড় লোকবান্ধব। মূল্যস্ফীতি হলে আমরা মূদ্রানীতি ব্যবহার করি না। কারণ মূল্যস্ফীতিতে গরিব মারা পড়বে তাতে কারো কিছু যায় আসে না।

সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদহার কমছে। ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যাংকের মেয়াদি আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মেয়াদি আমানতের সুদহার বেশি কমে গেলে জনসাধারণ সঞ্চয়ে নিরুত্সাহিত হন। ফলে অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ খাতসহ বিভিন্ন অনুত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ে। আমানতের সুদহার বেশি কমে গেলে ভবিষ্যতে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

সর্বশেষ - সকল নিউজ

আপনার জন্য নির্বাচিত