ড. কামালের জামাতা ডেভিড বার্গম্যানের মিডিয়া পার্টনার নেত্র নিউজের তাসনিম খলিল চান্স পেলেই সর্বত্র বলে বেড়ান, শেখ হাসিনার সরকার নাকি তাকে দেশছাড়া করেছে! বছরখানেক আগে আল-জাজিরায় এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসমিন খলিলকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কবে দেশ ছেড়েছেন? খলিল তখন মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন।
কী বলার আছে তার? ২০০৭ সালের ১১ মে বিদেশে তথ্যপাচার ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে সময় ‘প্রিন্স অব বগুড়া’ [এ নিয়ে তাসনিম খলিলের নিজের লেখা বক্তব্য সংযুক্ত হয়েছে নিচে] নামে তারেক রহমানকে নিয়ে এক অনুসন্ধানী ও চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশের প্রেক্ষিতে তারেকের অনুগত কিছু সেনাসদস্য দ্বারা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হন খলিল। ২২ ঘন্টা কয়েকদফা নির্যাতন এবং জেরার পর সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। এরপর তারপর পরিচিত কিছু এক্টিভিস্টের (যাদের বেশীরভাগই আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িত) তৎপরতায় তিনি দেশ ছাড়েন।
যারা তাকে সে সময় সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের নাম নিতে তিনি এখন লজ্জা পান। তাই কাঠের চশমা পরে ভাব নেন। তার এখনকার কথাবার্তা অনেকটা এমন- যেন পাকি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাকে উদ্ধার করেছিলো সে সময়। তাই এখন তাদের ঋণ শোধ করছেন তিনি স্বঘোষিত এনার্কিস্ট হয়ে, আল-জাজিরার দালালি করে। হয়ত, পেটের দায়েই করছেন। কিন্তু, তাই বলে শেখ হাসিনার সরকারের কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছে, এই চাপাবাজির দরকার কী?
সেনাবাহিনী যখন তাকে গ্রেপ্তার করে, তখন বলা হয়েছিলো- সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ইমেইলে ষড়যন্ত্র করছিলেন, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতনের জন্য!
তো বিষয়টা কী দাঁড়ালো? আপনি সজীব ওয়াজেদ জয়কে ইমেইল করবেন ক্ষমতায় বসাতে, ধরা খেয়ে উত্তম-মধ্যম খাবেন, আর সেই দোষ জয় কিংবা তার মা শেখ হাসিনার কেন হবে? তারা কি তখন ক্ষমতায় ছিলো? নাকি ধরিয়ে দিয়েছিলো? এখন আবার সেই সেনাবাহিনীকেই উস্কানি দিচ্ছেন? একে বলে স্টকহোম সিন্ড্রোম অর্থাৎ, যার দ্বারা নির্যাতিত নিষ্পেষিত হবেন, তার প্রেমেই মজে যাবেন, গুণে মুগ্ধ হয়ে পড়বেন।
তারেক রহমানকে নিয়ে সেই সচিত্র ও ভিডিও বক্তব্যসহ ‘প্রিন্স অব বগুড়া’ প্রতিবেদনে কী ছিল?
রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য নিজের লেখা আবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর ওয়েবসাইটে তাসনিম খলিল লিখেছেন- ২০০৭ সালের ১১ মে, বেলা ১২.৫০টায় তাকে গ্রেপ্তার করে তৎকালীন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। তাকে বাংলাদেশের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা- ডিজিএফআই এর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় তিনি ডেইলি স্টার ছাড়াও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর প্রকল্পে কাজ করতেন। সেই সাথে ছিলেন সিএনএন এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি। তাকে গ্রেপ্তার করা হয় মূলত দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকা, বিদেশি কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাকে রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর তথ্য পাচার করা এবং সম্প্রতি মেয়াদ পূর্ণ করা প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের জঙ্গিবাদে মদদ প্রদান, অর্থায়নের তথ্য প্রমাণ নিয়ে প্রতিবেদন করার দায়ে।
তার এবং তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত কম্পিউটার, ফাইল, নোটপ্যাড, সিডি, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রসহ বিভিন্ন জিনিস জব্দ করা হয় এ সময়। ইতিপূর্বে তাকে সতর্ক করে ডিজিএফআই দপ্তরে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেটি অগ্রাহ্য করেন বলে নিজেই জানান। এ সময় সেই দপ্তরে কর্মরত তারেক জিয়ার অনুগত কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা তাকে জেরা করেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, তারেক রহমান নিজেই এ ঘটনার মাস দুয়েক আগে ৮ মার্চ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার অনুগত সেনা কর্মকর্তারা ডিজিএফআইতে দায়িত্ব পালন করছিলেন, পাশাপাশি তারেককে নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন করায় ক্ষুব্ধ ছিলেন খলিলের ওপর।
খলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, ভারতে গিয়ে তথ্য পাচারেরও। বিদেশি দূতাবাসগুলো তাকে কেমন টাকা-পয়সা দেয়, সে সম্পর্কেও জেরা করা হয় সেখানে। ভারতীয়, অস্ট্রেলিয়ান, ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান দূতাবাসে তার পরিচিতদের সম্পর্কে তথ্য আদায় করা হয়।
তবে সবচেয়ে গুরুতর বিষয় ছিল- ফোরাম ম্যাগাজিনে তারেক রহমানকে নিয়ে প্রিন্স অব বগুড়া বা বগুড়ার যুবরাজ নামের সেই প্রতিবেদনটি। সেখানে বিস্তারিত নথিপত্রসহ তুলে ধরা হয়, কীভাবে তারেক রহমান জঙ্গি সংগঠনগুলোকে মদদ দিতেন, অর্থ সাহায্য করতেন। সেই সাথে দেশের শীর্ষ দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ মদদে কীভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলো সংগঠিত হচ্ছে, বিস্তার লাভ করছে সেসবও যুক্ত হয়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছিল ভিডিও তথ্য প্রমাণও। আন্তর্জাতিক খাতমে নবুওয়াত আন্দোলনের শীর্ষ এক নেতার সাক্ষাৎকার নেন তিনি। দাবি করেন, সংগঠনটি গড়ে ওঠার পেছনে জড়িত ডিজিএফআই। দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা চালানো জঙ্গি সংগঠন জেএমবি এবং জেএমজেবির পেছনে প্রধান মদদদাতা হিসেবে ডিজিএফআই এবং এনএসআই জড়িত বলে সেই প্রতিবেদনে দাবি করেন খলিল।
যার প্রেক্ষিতে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি ফান্ডিংয়ের বিনিময়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছেন বলে তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। জানা যায়, তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছিল আরও ৪/৫ বছর ধরে।
শুধু তাই নয়, তার বাসা থেকে জব্দ করা ল্যাপটপে প্রাপ্ত ইমেইলে দেখা যায় তাসনিম খলিল তার বন্ধু তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে রাজনৈতিক আলাপচারিতার কিছু তথ্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপে দেশ ছেড়ে প্রবাসে থেকে যেতে অস্বীকৃতি জানানো এবং দেশে ফেরা নিয়ে শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়ের বিষয়টি নিয়ে সিএনএন এর প্রতিবেদন করার বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন তিনি জয়ের সাথে। এটাকেই সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিযোগ উত্থাপন করে ডিজিএফআই। তারেক রহমানের অনুগত সেনা কর্মকর্তারা ক্ষিপ্ত হন খলিলের সাথে জয়ের সুসম্পর্ক দেখে। তারা দাবি করেন খলিল আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছেন বলে! অথচ খলিল দাবি করেছেন- আওয়ামী লীগ ও অন্য রাজনৈতিক দলের অনেকের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল, তবে আমি কোনো দলের সদস্য ছিলাম না এবং দলের রাজনীতিতেও জড়িত ছিলাম না। তারেকের অনুগত সেনা কর্মকর্তারা তাসনিম খলিলকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে উদ্ধারকৃত অস্ত্রসহ ফটোসেশনও করা হয়। প্রিন্স অব বগুড়া- প্রতিবেদনটা তারেক ও তার শুভাকাঙ্খীদের এতটাই ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ছেড়ে দেওয়ার আগে প্রচন্ড এক লাথি কষানো হয় তাসনিম খলিলের পশ্চাদ্দেশে, বলা হয়- যেন ভবিষ্যতে এসব কাজ করার সাহস না পায়।
অথচ তারেকবিরোধী এই তাসনিম খলিলই এখন উল্টো সুরে গান গাইছেন, তারেকের পক্ষে। যার কারণে নির্যাতিত, তার প্রেমেই মজে যাওয়া স্টকহোম সিন্ড্রোমে ভোগা তাসনিম খলিল এখন তারেক রহমানের পয়সায় বিএনপি-জামায়াত তথা জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে নাচছেন, ‘বন্ধু’ সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছেন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে অর্থদাতা আল-জাজিরার সাজানো প্ল্যাটফর্মে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেকের অনুগত তৎকালীন সেনাকর্মকর্তাদের সেই লাথির শোধ কি তবে এভাবেই নিজ জন্মভূমির ওপর তুলছেন খলিল?