উদ্বোধনের অপেক্ষায় স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল


admin প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩, ৯:২০ পূর্বাহ্ন | 476
উদ্বোধনের অপেক্ষায় স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল

টানেলের যুগে প্রবেশ করতে চলেছে বাংলাদেশ। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ বর্তমানে প্রায় ৯৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ।

তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের নির্মাণ কাজ ৯৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। যান্ত্রিক স্থাপনার কাজ এখনো চলছে। এরই মধ্যে অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে।’

হারুনুর রশিদ বলেন, ক্রস প্যাসেজ ও টানেল সম্পর্কিত টোলপ্লাজার নির্মাণ কাজও প্রায় শেষের দিকে রয়েছে। টানেলের যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক ও সিভিল ওয়ার্ক চলছে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজও শেষপর্যায়ে রয়েছে। টানেলের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক বিশাল পরিবর্তন এনে দেবে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাশ্রয় হবে কর্মঘণ্টা, কাজে আসবে গতিশীলতা। মানুষের জীবন হবে স্বাচ্ছন্দ্যময়। উন্নয়ন ঘটবে ওই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার। বাড়বে জাতীয় প্রবৃদ্ধি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টানেলটি চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনস’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একধাপ এগিয়ে যাবে। এই টানেলের এক পাশে চট্টগ্রাম শহর। আর অন্য পাশে রয়েছে আনোয়ারা উপজেলা। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের খুব কাছে থাকলেও উপজেলাটি এতদিন অবহেলিত ছিল। টানেল নির্মাণের মধ্য দিয়ে আরেকটি শহরে রূপ নিচ্ছে আনোয়ারা। আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে টানেলের সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র তিন মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতিতে গতি পাবে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে করা হচ্ছে এই টানেল। এটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে যুক্ত করে উন্নয়নকাজ ত্বরান্বিত করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ ত্বরান্বিত করবে। সর্বোপরি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হচ্ছে।

প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দরকে সরাসরি আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করা ছাড়াও সরাসরি কক্সবাজারকে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ৩৫ ফুট প্রস্থ এবং ১৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুটি টিউব ১১ মিটার ব্যবধানে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভারি যানবাহন সহজেই টানেলের মধ্য দিয়ে চলতে পারে।

টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪০ কিলোমিটার। এর সঙ্গে ৫.৩৫ কিলোমিটারের অ্যাপ্রোচ রোডের পাশাপাশি ৭২৭ মিটারের একটি ওভারপাসও রয়েছে, যা মূল শহর, বন্দর এবং নদীর পশ্চিম দিককে এর পূর্ব দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

টানেলকে কেন্দ্র করে অন্তত ১০০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ। নতুন শিল্প-কারখানাকে কেন্দ্র করে আনোয়ারা চাতরি চৌমুহনী বাজার ও সেন্টার এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট। আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চালু হয়েছে অন্তত ১০টি আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র। টানেল ঘিরে স্থানীয় উদ্যোক্তা, বিদেশি, বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকিং খাতে চলছে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি।

স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, টানেলকে কেন্দ্র করে হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও নতুন কর্মসংস্থান। ফলে বদলে যাচ্ছে এখানকার মানুষের জীবনমান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এক টানেল ঘিরেই অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, স্থানীয়দের জীবনমান পরিবর্তনসহ নানাভাবে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া টানেল হওয়ার কারণে ওই এলাকায় চীন ও কোরিয়া আরও ইপিজেড করতে আগ্রহী হচ্ছে। আগামীতে ভাটিয়ারী-পতেঙ্গা হয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে এটি যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে টানেল এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হবে। সামগ্রিক বিবেচনায় এক টানেল ঘিরেই অর্থনৈথিক বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। এর ইতিবাচক প্রভাব নিঃসন্দেহে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়বে।

উল্লেখ্য, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে সুদে ৫,৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং বাকি অংশের অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে টানেলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।