logo
Wednesday , 5 April 2023
  1. সকল নিউজ

স্বপ্ন পূরণ : পদ্মা সেতু দিয়ে চলল ট্রেন

প্রতিবেদক
admin
April 5, 2023 9:22 am

বদলে গেছে দেশের রেলওয়ের দৃশ্যপট। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে প্রথম বারের মতো চলল পরীক্ষামূলক বা ট্রায়াল ট্রেন। এর মধ্য দিয়ে আরেকটি স্বপ্নের মাইলফলক স্পর্শ করল বাংলাদেশ।

গতকাল মঙ্গলবার প্রথম যে ট্রেনটি পদ্মা সেতু পার হলো, তার ইঞ্জিন আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেটি টেনে নিয়ে গেছে চীন থেকে আনা সাতটি কোচ। ইঞ্জিন ও কোচ ফরিদপুরের ভাঙ্গা প্রান্ত থেকে রওনা হয় দুপুর ১টা ২১ মিনিটে। এরপর প্রথম স্টেশন মালিগ্রামসংলগ্ন বগাইলে পৌঁছায় ১টা ৪১ মিনিটে। ট্রেনটি গড়ে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগে চলে। ২টা ১০ মিনিটে শিবচরের পদ্মা স্টেশনে এসে পৌঁছায়। ২টা ৪০ মিনিটে পদ্মা সেতুতে ওঠে। পদ্মা সেতু পার হতে ১৬ মিনিট লাগে ট্রেনের। সব মিলিয়ে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া স্টেশন—এই ৪২ কিলোমিটার রেলপথে আসতে ট্রেনের সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এর আগে ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে ফিতা কেটে পরীক্ষামূলক বিশেষ এই ট্রেন চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।

এ সময় তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তার স্বপ্ন একটা একটা করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে আজ ট্রায়াল ট্রেন চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার অংশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করবে। ২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথে ট্রেন চলবে।’ উদ্বোধন শেষে ট্রেনের প্রথম যাত্রী হিসেবে পদ্মা সেতু পার হন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী, উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, ইকবাল হোসেন অপু এমপি, নাহিম রাজ্জাক এমপি, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এমপি ও আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি। তারাও ট্রেনে উঠে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া স্টেশনে নামেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক মেজর জেনারেল এ কে এম রেজাউল মজিদ, ডেপুটি সমন্বয়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কালাম আজাদ, প্রকল্প ব্যবস্থাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদ আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল পরীক্ষামূলক উদ্বোধনের দিনে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে ছিল উৎসুক জনতার ঢল। দুই পাড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ট্রেন চলাকালে উৎসুক জনতা রাস্তার দুই পাশে হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। রেলযাত্রা উপলক্ষ্যে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর ও মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর পিলারে আতশবাজি ফুটিয়ে উচ্ছ্বাস ও আনন্দ প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু ঘিরে নতুন রেলপথ বদলে দিল দেশের রেল নেটওয়ার্ক। বর্তমানে রেলপথে ঢাকার সঙ্গে খুলনার দূরত্ব ৪৬০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু হয়ে যশোর রেলপথে যাতায়াতে রাজধানী থেকে খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পদ্মা সেতুর রেল রুটটিও। পাথরবিহীন রেললাইন এই প্রথম তৈরি হলো বাংলাদেশে। যে ট্রেনটি ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়, সেই ট্রেনের চালক ছিলেন ৪৩ বছর বয়সি রবিউল আলম। এর আগে সোমবার রাতে এই বিশেষ ট্রেন সৈয়দপুর থেকে ঈশ্বরদী, পোড়াদাহ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, হয়ে ভাঙা স্টেশনে আসে। রবিউল আলম জানান, পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে প্রথম ট্রেন চালাচ্ছেন তিনি—এ কথা ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে ঘটনাটা তিনি জানতে পারেন এবং তারপর থেকেই তিনি দিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

জাজিরা প্রান্ত থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেনের তিনটি স্টেশন রয়েছে। শিবচরে দুটি স্টেশন এবং ভাঙ্গায় জংশন রয়েছে। স্টেশনগুলোর ওপর দিয়ে ৩২ কিলোমিটার লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ভাঙ্গা জংশনটি আধুনিকায়ন করার কাজ চলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে পদ্মা সেতু হয়ে চার জেলা (মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল) অতিক্রম করে যশোরের সঙ্গে রেলযোগাযোগ স্থাপিত হবে। রেলপথমন্ত্রী গতকাল ভাঙ্গা থেকে ট্রেনে করে এসে মাওয়া রেলওয়ে স্টেশনে নেমে সাংবাদিকদের বলেন, পুরো প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশের বেশি। আর পুরো প্রকল্পকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৭৪ ভাগ, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি ৯২ ভাগ এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। তবে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার অংশে আগামী সেপ্টেম্বর যাত্রীবাহী রেল চলাচলের আশা করছেন তিনি। আগামী বছরের জুনে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল চলাচল করবে। লেভেল ক্রসিংবিহীন এই রেলপথে ৩২টি রেল কালভার্ট, ৩৭টি আন্ডারপাস এবং ১৩টি রেল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের রেল স্টেশনসহ নতুন ১৪টি স্টেশন নির্মাণ এবং পুরোনো ছয়টি স্টেশন উন্নয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

ট্রেনে পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে রেল চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। সামাজিক বিপ্লব হবে। অথনৈতিক দিক থেকে মালইফলক হবে। শরীয়তপুর-২ আসনের এমপি ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের পরীক্ষা হলো। সড়কপথে যানজট সৃষ্টি হলেও রেলপথে কোনো যানজট হয় না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও কম খরচে তাড়াতাড়ি যাওয়াতের ব্যবস্থা হবে। ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু তৈরি করে দেওয়ার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।

মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, রেল সেতু চালু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়েছে। শরীয়তপুর-১ আসনের এমপি ইকবাল হোসেন অপু বলেন, আমরা কখনো ভাবিনি, পদ্মার ওপর দিয়ে সেতু হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা বাস্তবায়ন করেছেন।

সাধারণ মানুষ যা বললেন :শরীয়তপুর থেকে রেলের যাত্রী হয়েছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা জহির উদ্দিন সিকদার। তিনি বলেন, রেল সংযোগ চালু হওয়ার ফলে যোগাযোগব্যবস্থার নতুন দিগন্ত সূচিত হলো। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য কাজ করায় ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। রফিকুল ইসলাম নামক ৪৫ বছর বয়সি ভাঙ্গার এক বাসিন্দা বলেন, ‘জীবনে কখনো ভাবিনি ট্রেনে করে ঢাকায় যাব। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।’ ফরিদপুর জেলার তরুণ নামে একজন বলেন, রেললাইন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা পালটে যাবে।

ট্রেনে পদ্মা পাড়ি দিয়ে উচ্ছ্বসিত চালক-যাত্রীরা :পরীক্ষামূলক বিশেষ ট্রেন সফলভাবে পদ্মা সেতু অতিক্রম করায় দুই পাশে উৎসব বিরাজ করে। পদ্মার এপার-ওপার রেলপথ যুক্ত হওয়ায় উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ, চালক ও যাত্রী—সবার মধ্যেই উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। পদ্মা সেতুরি জাজিরা প্রান্ত দিয়ে প্রবেশের সময় আতশবাজির ঝলকানিতে এক বিশেষ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। চালক রবিউল আলম বলেন, ‘কর্মজীবন শুরু করার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রেন চালিয়েছি। তবে আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অধ্যায় হলো পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চালানো।’

সর্বশেষ - সকল নিউজ