logo
Sunday , 14 August 2022
  1. সকল নিউজ

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া হবে না

প্রতিবেদক
admin
August 14, 2022 9:50 am

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাস। তাকে ধনী লোক হিসাবে সবাই চেনেন, সম্মান করেন। তার সম্পদের কমতি নেই; ব্যবসা-বাণিজ্যও ঠিকঠাকভাবে চলছে। অথচ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে টাকা আর ফেরত দিচ্ছেন না। এ রকম ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ‘সিরিয়াস অ্যাকশনে’ যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

সম্প্রতি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে যুগান্তরকে আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, শীর্ষ ঋণখেলাপি এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখি না। কারণ, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার পর কেউ কেউ আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু আমার হারানোর কিছু নেই। তিনি বলেন, ১৫ থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে তিন হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে এক ডজন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির কাছে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি আটকে আছে।

জনতা ব্যাংকের এমডি আজাদ বলেন, ইতোমধ্যে সিরিয়াস অ্যাকশন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে রতনপুর গ্রুপ (১ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা), চৌধুরী গ্রুপ (৬৯১ কোটি), ইব্রাহিম গ্রুপ (৫৩৫ কোটি), বিসমিল্লাহ গ্রুপ (৫৫৮ কোটি), ডেল্টা কম্পোজিট (৩৬০ কোটি), এমআর গ্রুপ (৮০৭ কোটি), লিথুন ফেব্রিকস (৩০০ কোটি), ফাহমি গ্রুপ (২০০ কোটি) এবং এপেক্স নিট কম্পোজিটের (২০০ কোটি টাকা) বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, শুধু রতনপুর গ্রুপের বিরুদ্ধেই ৭৩টি মামলা করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপের মালিক গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। লুকিয়ে আছেন। টাকা না দিলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। শুধু তারাই নন, টাকা না দিলে পর্যায়ক্রমে অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জনতা ব্যাংকের সিইও আজাদ বলেন, খুব দ্রুতই খেলাপি ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে চাই। জনতা ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, ডলার কারসাজির অভিযোগে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দেওয়াটা গভর্নরের যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোর একটি। এর মাধ্যমে তিনি পুরো খাতকে বার্তা দিয়েছেন। আর বর্তমান পর্ষদ আমাকে অনেক বেশি সহযোগিতা করছেন। আশা করি, সবার সহযোগিতায় জনতা ব্যাংককে একটি ভালো অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।

৩৯ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা পূরণে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। চলতি বছরের সাত মাসে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ১৯ হাজার ১০৮ কোটি টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে এবং এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানিতে ১০ হাজার ৩১ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) ইস্যু করেছি। জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে পেট্রোবাংলা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার এলসি খুলেছে। এছাড়া রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামাল আমদানি বাবদ ১৬২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কৃষি যন্ত্রপাতি, সারসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি আমদানি বাবদ ৬১৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি বাবদ ১ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন বাহিনী ও দপ্তরের জরুরি সরঞ্জামাদি আমদানি বাবদ ৩০৯ কোটি টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে।

আজাদ জানান, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে প্রায় ৯৮ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণপত্র স্থাপন করে জনতা ব্যাংক, যা বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। এ প্রকল্পের শুরু থেকে সব বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। কাঁচামাল আমদানিতে ইতোমধ্যে ১৬২ কোটি টাকার এলসি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। প্রকল্পটির কয়লা আমদানিতে সম্প্রতি আরও ৫০০ কোটি টাকার এলসি ইস্যুর বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে। ডলার সংকট ও অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলো সরকারি আমদানি ঋণপত্র খোলার ব্যাপারে অনাগ্রহী হলেও জনতা ব্যাংক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ব্যাংকটির আমদানি ব্যবসার সিংহভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানের বলেও তিনি জানান।

জনতা ব্যাংকের এমডি আজাদ জানান, ২০২২ সালের প্রথম ৭ মাসে ব্যাংকের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমদানি ১৯ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, যা মোট আমদানির ৭৮ শতাংশ। তিনি বলেন, ২০২০ সালে জনতা ব্যাংকের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ২৭ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। ২০২২ সালে আমদানির লক্ষ্য ২৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ বছরের প্রথম ছয় মাসে ২০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার আমদানি হয়েছে। সম্প্রতি ডলারের কিছুটা সংকট থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এবং প্রয়োজনে খোলাবাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করে সরকারের চাহিদা পূরণে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

আজাদ আরও বলেন, ২০২০ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩০১ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ১৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। কোভিড-১৯-এর ধাক্কা শেষ না হতেই বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বব্যাপী চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবুও তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল, ওষুধ, চামড়া ইত্যাদি শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধিতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি বিভিন্ন অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতেও অর্থায়ন করে যাচ্ছি। ২০২২ সালের প্রথম ৬ মাসে ৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার রপ্তানি আয় হয়েছে। আশা করি, চলতি বছর জনতা ব্যাংকের রপ্তানির বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে কয়েক বছর আগে জনতা ব্যাংক বেশ চাপের মুখে পড়ে। ব্যাংকটির প্রায় ৩৪ শতাংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। সেখান থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানে যথেষ্ট ঘুরে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকটি। গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও ব্যবসায়িক সূচকে ধারাবাহিক অগ্রগতি তুলে ধরে আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জনতা ব্যাংককে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এর ফলও সবাই দেখছেন। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা অর্জিত হয় ৭০৯ কোটি টাকা। এরপর ২০২০ সালে ৯৮১ কোটি এবং ২০২১ সালে পরিচালন মুনাফা ১ হাজার ২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত বছর ব্যাংকের নিট মুনাফা অর্জিত হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে জনতা ব্যাংকের আমানত ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ কোটি টাকার ক্লাবে পৌঁছে গেছে, যা ২০২০ সালে ছিল ৮২ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকের মধ্যে সর্বাধিক ঋণ ও অগ্রিম বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক। ২০২০ সালে ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে ৬৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২-এর জুনে ঋণ ও অগ্রিমের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায়।

ব্যাংক খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় খেলাপি ঋণ। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের চাপে জর্জরিত। জনতা ব্যাংক খেলাপি ঋণ হ্রাসের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এ প্রসঙ্গে আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ২০১৮ সালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৭ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে ১৪ হাজার ৬০৩ কোটি, ২০২০ সালে ১৩ হাজার ৭৩৬ কোটি এবং ২০২১ সালে ১২ হাজার ৩২০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হলে খেলাপি ঋণ আরও হ্রাস করা সম্ভব হতো। প্রতিবছর পৃথক অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় হয়েছিল ১৭৯ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালে ২৮৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ২০২০ সালে নগদ আদায় ছিল ৪৮ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালে ৮৮ কোটি টাকা হয়েছে।

১৯৮৩ সালে সিনিয়র অফিসার হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকে ক্যারিয়ার শুরু করেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। একই প্রতিষ্ঠানে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এমডি অ্যান্ড সিইও পদে যোগদান করেন। এরপর ২০২০ সালে সরকার তাকে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব দেয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। এরপর কর্মজীবনে চেষ্টা করছি দেশের আর্থিক খাতে অবদান রাখার। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে জনতা ব্যাংকের এমডি হিসাবে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সেই আস্থার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সর্বশেষ - সকল নিউজ